জাতীয়

ছাত্রদ্রোহের মুখোমুখি রাষ্ট্র: আদালতের রায়ের পর রক্তাক্ত ২১ জুলাই

স্টাফ রিপোর্টার
স্টাফ রিপোর্টার

সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫ ২:০৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৪ সালের ২১ জুলাই—বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসে এক অস্থির ও বিভাজিত দিনের নাম।

সুপ্রিম কোর্টের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ের পাশাপাশি সেদিন রাজপথে ঝরেছিল সাধারণ মানুষের রক্ত। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ, ঘটে প্রাণহানি, জারি হয় কারফিউ, বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট, আর উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মহল।

ঐতিহাসিক রায়
সেদিন সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে মাত্র ৭ শতাংশ কোটা বহাল রেখে ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে পূরণের নির্দেশ দেয়। এর মধ্য দিয়ে হাইকোর্টের কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত রায় বাতিল করা হয়। আদালত পর্যবেক্ষণে জানায়, সরকার প্রয়োজনে কোটা পদ্ধতি বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে—যা কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয় নির্বাহী বিভাগের হাতে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই রায়কে সরকারের নৈতিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির কথা জানান।

রক্তাক্ত রাজপথ
আদালতের এই রায়ের পেছনে সরকার সমঝোতার বার্তা দিলেও, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ঢাকা ও দেশের ছয় জেলায় প্রাণ হারান ১৯ জন।

ঢাকায় নিহত ১০ জন
নরসিংদীতে ৪ জন
গাজীপুরে ২ জন
নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও চট্টগ্রামে ১ জন করে
শতাধিক আহত, অন্তত ৭০ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড, সানারপাড়, ধানিয়া, বসুন্ধরা, মিরপুর-১০—রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চলে গুলি, ধাওয়া ও পাল্টাধাওয়া।

কারফিউ ও তথ্য অবরোধ
২১ জুলাই ছিল টানা দ্বিতীয় দিনের কারফিউ। মোবাইল ইন্টারনেট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে নিজেদের বার্তা সংবাদমাধ্যমে পাঠায়। তাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী তিন শতাধিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত।

এই দিনেই আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে অপহরণ করে নির্যাতনের পর ফেলে রাখা হয় পূর্বাচলে। তিনি জানান, সাদা পোশাকে আসা লোকজন চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালায়।

বিভ্রান্তি ও প্রতিক্রিয়া
বিকেলে নাহিদসহ তিনজন সমন্বয়ক ৪৮ ঘণ্টার জন্য শাটডাউন স্থগিত করার ঘোষণা দেন এবং চারটি দাবি উত্থাপন করেন:
১. কারফিউ প্রত্যাহার
২. ইন্টারনেট চালু
৩. আবাসিক হল খুলে দেওয়া
৪. আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত

তবে অন্যান্য সমন্বয়করা এই ঘোষণার বিরোধিতা করে ৯ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার তুর্ক বলেন, "বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা গভীর উদ্বেগজনক।" তিনি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে এবং অপ্রয়োজনীয় দূতাবাস কর্মীদের দেশে ফিরে যেতে বলে।

রাজনীতি বনাম বাস্তবতা
সরকার আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করে, অপরদিকে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল সরকারকে "ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা" বলে অভিযুক্ত করে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আদালতের রায়ে প্রশ্ন তোলেন এবং একে সরকারের ‘ইচ্ছার প্রতিফলন’ বলে অভিহিত করেন।

বিভক্তি ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
২১ জুলাই রয়ে গেল একটি প্রতীকি দিন হিসেবে—যেখানে আদালতের রায়, সরকারের অবস্থান, এবং রাজপথের ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ এক ভিন্ন বাস্তবতার চিত্র আঁকে। প্রশাসনিকভাবে এটি একটি ‘সমাধান’-এর দিন হলেও, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের আস্থার জায়গায় এটি ছিল ভাঙনের দিন।

এই দিনটি যেন স্মরণ করিয়ে দেয়—গণআন্দোলন, রক্ত, রায় এবং রাষ্ট্র—সব একসূত্রে বাঁধা, কিন্তু সব সময় একমত নয়।

১৩৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন