১৭ ও ১৮ জুলাই ২০২৪: শহীদদের রক্তে ভাসা ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ, ইতিহাস বদলের দিন

শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫ ৮:১০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৮ জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বেদনা-বিহ্বল, চিরস্মরণীয় দিন। এদিন সারাদেশজুড়ে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান, সরকারি নিপীড়ন এবং ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শহীদের রক্ত, সমবেত জনতার বিপুল চিৎকার আর প্রশাসনের নির্লজ্জ অমানবিকতায় দিনটি হয়ে ওঠে গণ-অসন্তোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
এই দিনে আন্দোলনে প্রাণ হারান ১৯ জন তরুণ-তরুণী, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এই তরুণদের অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন প্রতিবেদনে ১৯ থেকে ২৬ জনের মধ্যে বলা হয়েছে। এদিন নিহতদের তালিকায় সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ছিল মির মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ—যাঁর মৃত্যু আন্দোলনের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
মির মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, আন্দোলনকারীদের খাবার-পানি বিতরণের সময় উত্তরা, ঢাকা—গুলিতে নিহত)
শাকিল পারভেজ (মনারাত ইউনিভার্সিটি, ঢাকা—পুলিশের গুলিতে নিহত)
ফারহান ফাইয়াজ (ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা—পুলিশের গুলিতে নিহত)
শরিফ হাসান (ইম্পেরিয়াল কলেজ, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
শেখ ফাহমিন জাফর (টঙ্গী সরকারি কলেজ, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
শাহনেওয়াজ ফাহাদ (ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
তাসাউফ উল আলম (প্রতিষ্ঠানের নাম জানা যায়নি, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
জাহিদুজ্জামান তানভিন (ইঞ্জিনিয়ার, আইইউটি, ঢাকা—পুলিশের গুলিতে নিহত)
আসিফ হাসান (নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা—সহিংস ঘটনায় নিহত)
জুনায়েদ হোসেন আদনান (নটরডেম কলেজ, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
দীপ্ত দে (মাদারীপুর সরকারি কলেজ, মাদারীপুর—আন্দোলনে গুলিতে নিহত)
শেখ আশহাবুল ইয়ামিন (মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, সাভার, ঢাকা—পুলিশের গুলিতে নিহত)
তাহমিদ তাামিম (কাদির মোল্লা উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী—আন্দোলনে নিহত)
ইকরা (নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, নারায়ণগঞ্জ—সংঘর্ষে নিহত)
ইমন মিয়া (প্রতিষ্ঠান অজ্ঞাত, নরসিংদী—আন্দোলনে নিহত)
মো. ইরফান ভূঁইয়া (ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা—আন্দোলনে নিহত)
মোহাম্মদ ইমাদ (পটিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম—সংঘর্ষে নিহত)
জাহিদুজ্জামান তানভিন (আইইউটি, প্রকৌশলী, ঢাকা—গুলিতে নিহত)
অবং হাসান মেহেদী (সাংবাদিক, ঢাকা টাইমস, ঢাকা—সংঘর্ষে নিহত)….
১৮ জুলাই দিনের শুরু থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের সর্বত্র ছাত্র-জনতার শোণিত-প্রবাহিত দৃপ্ত পদযাত্রা বিস্তৃত হয়। সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীদের আহ্বানে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল শহর ও গ্রাম; শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত হন অভিভাবক, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষ।
রাজপথের অন্যপ্রান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান কঠোর ছিল। সকাল থেকেই পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াত বাহিনী রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে টহল শুরু করে। মিছিল বাধা, রাস্তা অবরোধকারীদের ওপর সরাসরি গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপে বহু আহত হন এবং ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুজন। বেলা গড়াতে মাঝরাস্তায় ব্যারিকেট, বন্দুকযুদ্ধ, অনেক স্থানে কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট-বিচ্ছিন্নতার কারণে যোগাযোগ একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর মৃত্যুর খবর ধাপে ধাপে বাড়ে। খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় একাধিক তরুণ নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন রাজপথে—এদের মধ্যে মুগ্ধর শেষ মুহূর্তের মানবিকতা (পানি বিতরণ), ভাইরাল ভিডিও, ও তাঁর শহীদ হওয়ার ঘটনা আন্দোলনকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও উগ্র করে তোলে।
পুলিশ ও প্রশাসন এককভাবে আন্দোলন দমনের কৌশল নেয়; রাত বাড়ার সাথে সাথে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় বিপুলসংখ্যক গ্রেফতার, বাড়িতে বাড়িতে হানা, শিক্ষার্থীসহ নারীরাও আহত হন। কারফিউ ঘোষণার আগে রাজধানী ও শহরতলিতে বহু আন্দোলনকারী গুম-নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে।
এই দিন জুড়ে সবচেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ ও সমমনা সংগঠনের সংগঠিত হামলা, সরকারি দলের কিছু নেতাকর্মী পুলিশের সঙ্গে এবং পৃথকভাবেও শিক্ষার্থীদের ওপর বারবার হামলা চালায়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও জাতীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, ১৭ জুলাই ২০২৪ তারিখে অন্তত ৬ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রংপুর শহরে এসব মৃত্যুর তথ্য উল্লেখিত হয়েছে।
১৬ জুলাই ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাস ও বড় শহরগুলোতে “গায়েবানা জানাজা” এবং প্রতীকী কফিন-মিছিল হয়। মিছিলকারীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ছাত্রলীগের অংশের ওপর দিয়ে চলে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও রাবার-বুলেটের বৃষ্টি।
১৭ জুলাই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী আদালতের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেও পরিস্থিতি নমনীয় হয়নি। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন আরও চাঙ্গা করার প্রতিজ্ঞায় ঐক্যবদ্ধ হয়।
এই দুই দিনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতা কর্তৃক সংঘটিত এই বৃহত্তম গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রীয় নির্মমতা ও মানবিকতার সংগ্রামে একগুচ্ছ শহীদের রক্ত, প্রতিবাদের স্লোগান এবং শেষ পর্যন্ত রাজপথের বিজয়ফুল হয়ে রইল। ইতিহাসে ১৭ ও ১৮ জুলাই ২০২৪ চিরকাল থাকবে ছাত্র-জনতার গণপ্রতিরোধ ও নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশার বর্ণিল স্বাক্ষর হিসেবে।
১৩৪ বার পড়া হয়েছে