মতামত

সন্তান বিপথে কেন? — সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিভাবকত্বের ব্যর্থতা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

বৃহস্পতিবার , ১৭ জুলাই, ২০২৫ ৬:৪৭ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাবা ছিলেন একজন প্রিন্সিপাল টিচার, পারিবারিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এসএসসি পরীক্ষার সময় প্রথমবার চামড়ার জুতা পরেছিলাম। তার আগে পর্যন্ত বাটার সানডাক জুতা-ই ছিলো আমার ভরসা।

ক্লাস নাইনে উঠেই প্রথম একাধিক জামা পড়ার সৌভাগ্য হয়। ক্লাস এইটে উঠে স্কুল ব্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করি—সেই ব্যাগই ছিলো ঘুরতে যাওয়ার সঙ্গী। এসএসসি পর্যন্ত লুঙ্গি পরে নিয়মিত ক্লাসে যেতাম, যা এখন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য শোনাবে। আমার শৈশব-কৈশোরের এই সরলতা আজও গর্বের স্মৃতি হয়ে আছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পাওয়ার পর নিজের ইচ্ছে মত ড্রেস কেনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

বর্তমান সময়ে সন্তান লালন-পালনের বিষয়টি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের অভিজ্ঞতা নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, নৈতিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক ইস্যু। বাংলাদেশে একের পর এক এমন ঘটনা সামনে আসছে, যেখানে সন্তান বাবা-মা’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, এমনকি কখনো সহিংসতায়ও জড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী, বিশেষ করে “মেহেরীন প্রসঙ্গ” এবং অতীতে ঘটে যাওয়া ঐশী রহমান কাণ্ড, আমাদেরকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে—সন্তান কোথায় এবং কেন ভ্রান্ত হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের একদিকে বিশ্লেষণ করতে হবে পরিবার কাঠামোর বর্তমান ধরণ, অন্যদিকে আধুনিক অভিভাবকত্বের ব্যর্থতা, মনোবিজ্ঞানের আলোকে সন্তান বিকাশের ধাপ ও ইসলামী মূল্যবোধ ভিত্তিক অনুশাসনের অবক্ষয়। সন্তান গঠনে অভিভাবকের ভূমিকা: একটি মনোবৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা-
১.বাউমরিন্ড তত্ত্ব (Baumrind's Parenting Styles)
অভিভাবকত্বকে চারটি শৈলীতে ভাগ করেন: Authoritative (দায়িত্বশীল অথচ সহানুভূতিশীল), Authoritarian (কঠোর ও নিয়ন্ত্রণমূলক), Permissive (অতিপ্রশ্রয়দায়ী), Neglectful (উপেক্ষনামূলক)

আধুনিক সমাজে যেসব পিতামাতা সন্তানদের “না” বলতে পারেন না, তাদেরকে প্রাধান্য দিয়ে বড় করেন, তাদের আচরণ পড়ে ‘Permissive Parenting’ এর আওতায়।
গবেষণায় দেখা যায়, এই ধরনের অভিভাবকত্ব শিশুর আত্মনিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দেয়, আত্মপ্রেম বাড়িয়ে দেয় এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করে তোলে। ২. ‘The Narcissism Epidemic’ বইয়ে বলেন—“যখন শিশুকে তার সবকিছুই বিশেষ মনে করিয়ে দেওয়া হয়, এবং কোনো ভুলের দায় দেওয়া হয় না, তখন সে নিজেকে পৃথিবীর কেন্দ্র ভাবতে শেখে।” ফলাফল দাঁড়ায়, তারা যেকোনো না পাওয়া বা বাধা সহ্য করতে পারে না। ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও অভিমান থেকে এক সময় আত্মীয়-পরিজনকেই ‘শত্রু’ ভাবা শুরু করে।
পারিবারিক মূল্যবোধের সংকট: বাংলাদেশি সমাজের বাস্তবতা
১.সন্তানকে দেবতার মতো আরাধনার প্রবণতা-
বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও শহরকেন্দ্রিক পরিবারগুলোতে একমাত্র সন্তানকে “অপূরণীয় সম্পদ” মনে করে তার সকল চাহিদা পূরণ করাকে অভিভাবক কর্তব্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই ধারা শিশুকে তৈরি করে এক ‘স্বার্থান্ধ, তাত্ক্ষণিক সুখ-পিয়াসু’ মনন। তার কাছে বাস্তবতা, সীমাবদ্ধতা, অপেক্ষা—এসব হয়ে পড়ে অপমানজনক।
বলা বাহুল্য, সন্তান বড় হয়ে কোনো প্রত্যাশা পূরণ না হলে কিংবা সামান্য বারণ পেলেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
২. ‘Good Parenting’ বনাম ‘Right Parenting’- আধুনিক অভিভাবকরা সন্তানকে দোষ দিলে ‘আত্মবিশ্বাস হারাবে’, এমন অজুহাতে কখনো শাসন করেন না। কিন্তু উন্নয়নশীল মানসিকতা তত্ত্ব (Growth Mindset) এর প্রবক্তা Carol Dweck (Stanford University) বলেন, “শিশুকে প্রশংসা করতে হবে তার প্রচেষ্টা ও শৃঙ্খলার জন্য, কিন্তু অন্ধভাবে নয়। ভুল হলে পরিণতি ভোগের শিক্ষাও দিতে হবে।”

ইসলামি দৃষ্টিকোণ: দায়িত্ব ও আদর্শের শিক্ষা- ইসলাম সন্তানের প্রতি দয়া ও দায়িত্ব দুটোই একত্রে পালন করার শিক্ষা দেয়। হযরত আলী (রা.) বলেন: "তোমাদের সন্তানদেরকে প্রথম সাত বছরে আদর করো, পরবর্তী সাত বছরে শাসন করো, এবং এরপর তাদের বন্ধু হয়ে ওঠো।"
(ইমাম গাজ্জালি, ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন) এই হাদীস-ভিত্তিক প্রজ্ঞা আমাদের বলে—সন্তান লালন-পালনের ধাপে ধাপে আলাদা কৌশল প্রয়োজন।

কুরআনের ভাষায়: "হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার- পরিজনকে রক্ষা করো সেই আগুন থেকে যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরীম, ৬) অর্থাৎ সন্তানের ঈমান-আখলাক রক্ষা পিতামাতার দ্বীনী দায়িত্ব।

ঐশী ও মেহেরীন প্রসঙ্গ: সমাজ কী শিখলো?

ঐশী রহমান কাণ্ড ছিল একটি অজগর সতর্ক সংকেত। অত্যধিক স্বাধীনতা, রাত জাগা জীবন, মাদকাসক্তি এবং আত্মকেন্দ্রিকতা—এই সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল ঐশীর মনন। একপর্যায়ে তার কাছে বাবা-মা হয়ে গিয়েছিল একটি “বাধা”।

মেহেরীন তার বাবা-মাকে আদালতে অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত করতে চাচ্ছে। বাস্তবিক দিক বিচার না করেও বলা যায়, এটি একটি পারিবারিক মূল্যবোধ ও আত্মিক বন্ধনের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

শিশুকে কিছুটা অভাব ও সীমাবদ্ধতার স্বাদ দেওয়া জরুরি-আমরা যারা ১৯৭৫-১৯৯৬ এর মধ্যবর্তী প্রজন্মে বড় হয়েছি, তাদের অনেকেই জানি—প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বছরে একবার বা ঈদে পাওয়া যেত। জুতা হারালে ভয়ে কাঁদতাম, কারণ জানতাম এটি সহজে পূরণ হবে না। এই অপেক্ষা আমাদের মধ্যে গড়ে তুলেছে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও মূল্যবোধ।

Harvard Child Development Center তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে—Children who experience structured limitations and consequences during their developmental years show stronger emotional regulation and social resilience in adulthood.

অর্থাৎ, অভাব নয়, ‘সংযমের শিক্ষা’ শিশুকে সফল মানুষ করে তোলে।

পরিবারে নৈতিক পুনর্গঠনঃ
১. Positive discipline: প্রশংসা ও শাস্তির ভারসাম্য
২. Delayed gratification শেখানো: সবকিছু তৎক্ষণাৎ পাওয়া যায় না
৩. পারিবারিক শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় শিক্ষার চর্চা
৪. ‘না’ বলতে শেখা ও শেখানো
৫. মানসিক স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার গুরুত্ব বোঝানো
৬. পরিবারে সম্মান ও দায়িত্ববোধ চর্চা

আজকে যারা আদালতে দাঁড়িয়ে বাবা-মাকে “অপরাধী” বলছে, তারা হয়তো নিজেরা বুঝতেই পারেনি যে তার এই মনোভাব তৈরি হয়েছে সেই বাবা-মা’র অতিমাত্রায় প্রশ্রয় ও সীমাহীন আদরের মধ্য দিয়ে। সমাজে যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে আমরা কেবল সন্তান হারাবো না, হারাবো একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ কাঠামো, যেখানে পরিবারই ছিল নিরাপত্তার শেষ দুর্গ।

তাই এখনই সময়—সন্তান গঠনে ভারসাম্যপূর্ণ, জ্ঞানভিত্তিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধসম্মত অভিভাবকত্ব গড়ে তোলার। না হলে নিজেরই DNA একদিন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, আর তখন আমরা একা থাকবো—অভিভাবকত্বের ভুলের দায়ে, ইতিহাসের কাঠগড়ায়।

লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা।

১১০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন