মতামত

জাতীয় নির্বাচনে পি.আর. পদ্ধতি

সরকারের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ

রেজাউল করিম
রেজাউল করিম

বৃহস্পতিবার , ১৭ জুলাই, ২০২৫ ৫:৩৩ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
আমার মুল লেখা শুরু করার পূর্বে আসুন জেনে নেই— পি আর পদ্ধতি কি ? যা জেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

PR বা Proportional Representation বা 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায়’ বা পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পাবে। আমরা জানি বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থা ৩০০ আসন বিশিষ্ট । তার মানে দাঁড়ায়—সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে প্রতি ১ শতাংশ ভোটের জন্য তিনটি আসন পাওয়া যাবে। তাই পি. আর পদ্ধতিতে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল তাদের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।


আপনারা যদি বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবেন — ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০.৮% ভোট পেয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ ৩০.১% ভোট পেয়েছিল যার বিপরীতে তাদের আসন ছিল যথাক্রমে ১৪০টি ও ৮৮টি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪% ভোটে ও বিএনপি ৩৩.৬% ভোট যার বিপরীতে তাদের আসন ছিল যথাক্রমে ১১৬টি ও ১৪৬টি। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৫.৫৯% এবং বিএনপি ৪০.৪১% ভোট পায়। খেয়াল করে দেখবেন, আওয়ামী লীগ ৪০.২% ভোট পেয়েও মাত্র ৬২টি আসন পায়। আবার ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৯% ভোট এবং বিএনপি ৩৩.২% ভোট পেয়েছিল।

১৯৯১ সালে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বা অনুপাতে আসন নির্ধারিত হলে বিএনপি আসন পেত ৯৩টি আর আওয়ামী লীগ পেত ৯০টি। একি ভাবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আসন পেতো ১১৩টি আর বিএনপি পেত ১০১টি।। ২০০২ সালেও একি ভাবে বিএনপি আসন পেত ১২৪টি আর আওয়ামী লীগ পেত ১২০টি। ২০০৮ সালে যদি একি পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো তাহলে আওয়ামী লীগ আসন পেত ১৪৭টি, বিএনপি পেত ৯৯টি। এমন বৈশিষ্ট্যগত বৈষম‍্যের বিরোধিতা আমরা করতেই পারি কিন্তু তাই বলে এমন বিরোধিতা আমাদেকে কি একটি সুস্থ ও সুন্দর গনতন্ত্র উপহার দিতে পারবে?

এখন প্রশ্ন হতে পারে—-জাতীয় নির্বাচনে পি.আর. পদ্ধতি সরকারের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কেন হুমকি স্বরূপ ?

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি (First past the post) এর পরিবর্তে কিছু দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে পি.আর. পদ্ধতি চালুর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মোটাদাগে পি.আর. পদ্ধতির নেতিবাচক দিকগুলো নিম্নরূপ:

(১) পি.আর. পদ্ধতি সংসদীয় আসন ভিত্তিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায় না, জনগনের নিকট নেতৃত্বের দায়বদ্ধতাও থাকে না। নিত্যদিন রাত পোহালেই দেখা যায় এম.পি সাহেবের ড্রয়িংরুমে ৫০/৬০ জন লোক নানাবিধ সমস্যা সমাধান/মীমাসংসার জন্য বসে আছেন। এম.পি সাহেবকে পারিবারীক সমস্যা এমনকি ক্ষেতের আইল ঠেলাঠেলি, মুরগী চুরির সালিসীও করতে হয়। এটা ভোটের রাজনীতি, এখানে বলা যাবে না, আমি এম.পি, "আমার কাজ সংসদে আইন প্রনয়ন করা।" ইহাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা।

(২) পি.আর. পদ্ধতিতে ভোটার বা নির্বাচক মন্ডলী জানতে পারবে না কে তাঁদের সংসদ বা নেতা হবেন। প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার ডঃ এনায়েত উল্লাহ্ আব্বাসীর মতে- কোন ব্যক্তিকে না চিনে, না জেনে, ভাল-মন্দ বিচার বিশ্লেষন না করে ভোট দেয়া "না-জায়েজ" তাহা ইসলামের পরিপন্থী।

(৩) পি.আর. পদ্ধতিতে ধরা যাক, কোন নির্বাচনী আমলে একটা প্রতীক বিশ হাজার ভোট পেলো, অন্য প্রতীক তিন লক্ষ বিশ হাজার ভোট পেলো। সারা দেশের সকল আসনের মোট ভোটের হিসেবে উক্ত আসনে বিশ হাজার ভোট পাওয়া প্রার্থীর প্রতীক সারা দেশের এক শতাংশের এক তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে একটি আসন লাভের উপযুক্ততা অর্জন করলো এবং বিশ হাজার ভোট পাওয়া আসনে সংসদ হিসেবে ঘোষিত হলো-তদ্রুপ ক্ষেত্রে ঐ সংসদীয় এলাকার জনগন তথা নির্বাচক মন্ডলীর প্রতি স্বাভাবিক ন্যায় বিচার (Natural Justice) প্রতিষ্ঠিত হলো কি?

(৪) ফ্যাসিষ্ট পূণর্বাসনের সূক্ষ ষড়যন্ত্রঃ আমাদের দেশে ব্যাংক লুটেরা, লক্ষ-কোটি টাকা
পাচারকারী, বিদেশে ছয় শতাধিক গাড়ীর মালিক, বেগম পাড়ার বাসিন্দা, অলিগার্ক-মাফিয়া দূবৃত্ত চক্র এখনো সক্রিয় রয়েছেন। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মত বৃহৎ প্রতিবেশীতো লাগাতার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন।
এমতাবস্থায়, পতিত ফ্যাসিষ্টের প্রেতাত্মা-গোঁড়া সমর্থক কম-বেশী ২০ শতাংশ ভোট পেলেও পি.আর পদ্ধতিতে ৬০টি আসন পেয়ে সংসদীয় বিরোধী দল হয়ে থাকে। যাঁরা নামের সঙ্গে এম.পি পদবী লাগানোর জন্য, ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ির জন্য,স্ট্যাটাস হাই করার জন্য কসরত করতেছেন তাঁরা কি প্রকারান্তরে ফ্যাসিষ্ট পূনবাসনের (Meticulous Design) সূক্ষ উপপ্রয়াসে লিপ্ত নন?

(৫) দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী (আমি মেজর রেজা নিজেও) জীবন বাজী রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের অখন্ডতা রক্ষায় সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছি। দেশের এক দশমাংশ (পার্বত্য এলাকা) ভূমির সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী অকাতরে জীবন দিয়েছেন। পি.আর পদ্ধতিতে উপজাতীয়রা 'আদিবাসী' জুমল্যান্ড নামে ৮/৯ টা আসন পেয়ে বিদেশী মদতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আগ্রাসন পুনরায় চালাবে না-এর গ্যারান্টি কি?

(৬) হিন্দু-বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ (জনসংখ্যা সাড়ে ৮%) পি.আর. পদ্ধতিতে ১০/১২ টা আসন পেয়ে 'ইসকনি' খেলায় মেতে উঠবে না? এই ইসকন, স্বদেশী বিজেপি, প্রতিবেশী বিজেপি, পলাতক বিজেপি কি রঙ দেখাবে বুঝহ সুজন, যে কর চিন্তন।

(৭) জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, চরমোনাই, ক্ষুদ্র ইসলামী দল সমূহের ভোটের শতাংশের কথা বললে তাঁরা রাগ করবেন। [জামায়াতের একা একা নির্বাচন করার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা একবার অখন্ত ঢাকা মহানগরীতে মেয়র ইলেকশন করে হাজার দশেক ভোট পেয়েছিলেন)। বাংলাদেশে দলের সংখ্যা তো শতক অতিক্রম করেছে। রক্তচোষা রফিকুল আমিনও দল খুলেছে।

(৮) পি.আর পদ্ধতিতে ভোট হলে বৃহৎ দল বিএনপি, গনতন্ত্র মঞ্চ ও সমমনা জাতীয়তাবাদী ঘরানার দলসমূহ সর্বোচ্চ ৪৫% ভোট পেয়ে ১৩৫টি আসন পেতে পারেন অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করলেও সর্বক্ষন চাপে থাকবে। সরকার হবে অস্থিতিশীল, অর্থনীতি হবে ভংগুর, বিদেশীরা বড় বড় প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট করতে সাত-পাঁচ ভাববে। ছোট ছোট দলগুলোর পোয়াভারো হবে, আধিপত্যবাদী নিকট প্রতিবেশী ঢোল বাজাবে, মায়ানমার তার নাগরিকদের সৌৎসাহে ঠেলে পাঠাবে বাংলাদেশে বলবে এদের পূর্বপুরুষ চিটাগংগিয়ান, ওরা রোহিংগা।

আশংকা করা যাচ্ছে ইউপি, চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়রগনও এক সময় পি.আর পদ্ধতি দাবী করে চলবে তুমি তিন হাজার ভোট পেয়েছ, তুমি তিন বছর ক্ষমতায় থাক, আমি দুই হাজার পেয়েছি আমি পরবর্থী দুই বছর থাকব।

পৃথিবীর উন্নত দেশ যেখানে স্থানীয় সরকার এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই শক্তিশালী সেখানেও পি.আর পদ্ধতি হোঁচট খাচ্ছে। ১৯৪৬ সাল থেকে এ যাবৎ ইটালীতে ৩০ বার প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের পাশের দেশ নেপালে ৪০% পি.আর পদ্ধতি। সেখানেও বার বার সরকার বদল হয়। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থাতো খুবই নাজুক।

এমতাবস্থায় দেশমাতৃকার স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে, ঘন ঘন সরকার পরিবর্থনের ফলশ্রুতিতে ভংগুর অর্থনীতির ধকল থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য, আধিপত্যবাদী হায়নার লোলুপ দৃষ্টি থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব তথা প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চি জমি সুরক্ষার জন্য স্বার্থে যেন-তেন উপায়ে এমপি হওয়ার উদগ্র লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। মাথা থেকে পি.আর পদ্ধতির ভূত তাড়িয়ে সাচ্চা দিলে বলতে হবে সবার আগে আমার দেশ, আমার মাতৃভূমি। নেতৃত্ব আল্লাহর দান- আল্লাহ্ পাক বলেছেন "(কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি তুতিল মুলকা মান্তা শা'উ, ওয়া তানজিউল মুলকা মিম মানতাশা'উ ওয়া-তু ইজ্জু মান্তা শা'উ, ওয়াতু জিলু মান্তা শাউ বিআদি কাল খাইর-ইন্নাকা আলা কুল্লে শাউয়িন ক্বাদীর)। অর্থাৎ আল্লাহ পাক যাকে খুশী ইজ্জত দান করেন, যাকে খুশী বেইজ্জতি করেন, যাকে খুশী দরিদ্র করেন, যাকে খুশী বেশুমার রিজিক দান করেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করুন।

লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক

১৪৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন