সন্ত্রাসী লিপটন: রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, পারিবারিক প্রভাব ও চরমপন্থী উত্থান

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫ ৪:৪৬ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থী রাজনীতির উত্থানে অন্যতম আলোচিত নাম জাহাঙ্গীর কবির লিপটন।
একসময় ছাত্রলীগ, পরে গণমুক্তি ফৌজ ও ‘জাসদ গণবাহিনী’—তারপর নিষিদ্ধ দলে যুক্ত হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাজনৈতিক প্রভাব, পারিবারিক প্রশাসনিক সংযোগ এবং উগ্র কর্মকাণ্ডের মিশেলে তার কাহিনী বাংলাদেশে স্থানীয় শক্তি-রাজনীতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
উত্থানের সূচনা: ছাত্ররাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ দলে যাত্রা
৯০-এর দশকে কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগ ক্যাডার হিসেবে লিপটনের উত্থান শুরু।
দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর সে ২০০০ সালে গণমুক্তি ফৌজে (একটি নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন) মুকুল-শাহীনের নেতৃত্বে যুক্ত হয়। সংগঠনের আদর্শ ভুলে চাঁদাবাজি, খুন ও অপহরণসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়লে, ২০০৬ সালে গণমুক্তি ফৌজ থেকে বহিষ্কৃত হয়। বহিষ্কৃত হওয়ার পরও, সে ‘জাসদ গণবাহিনী’র কালুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে নতুন অপরাধ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে।
নিষিদ্ধ দলের নেতৃত্ব ও চরমপন্থী কর্মকাণ্ড
প্রধান মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জাসদ গণবাহিনীর কালুর ডানহাত হয়ে ওঠে লিপটন। ২০০৯, ২০১১, ২০১২—বিভিন্ন আলোচিত খুন, গুম, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। সীমান্তবর্তী এলাকায় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিরোধীদের হত্যা এবং ত্রাস সৃষ্টি ছিল তার চরমভাবে ব্যবহৃত কৌশল।
হানিফের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়া
আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফের সঙ্গে লিপটনের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। লিপটন হানিফের অনুষ্ঠান, সভা–সমাবেশে অতিথির মতো স্থান পেতো এবং দলের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ও প্রোগ্রামে তাঁর পাশে থাকতো।
পাশাপাশি, হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতার সঙ্গে লিপটনের সরাসরি সখ্য ও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আতাও স্থানীয় ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক চ্যানেল ও রাজনৈতিক দাপট প্রতিষ্ঠায় লিপটনের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। এই পরিবারিক-মোটিভ ক্ষমতার জাল লিপটনের অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে। ক্ষমতাসীন দলের এই ঘনিষ্ঠতার ফলে, যত অপ্রকাশ্য কাজই করুক না কেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহুদিন ধরেই কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খুন, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন অপরাধ অবাধে চালিয়ে যায়।
স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিপটন ছিল ক্ষমতাবান, ভয়ংকর এবং দুর্নিবার এক চরিত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রায়শই তার বিরুদ্ধে নরম মনোভাব পোষণ করত।
ভাই উপসচিব আলমগীর কবিরের প্রশাসনিক প্রভাব
লিপটনের ভাই আলমগীর কবির নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে আছেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ, ভাইয়ের প্রশাসনিক পদ ব্যবহার করে অস্ত্র ও অপরাধে অভিযুক্ত লিপটন বারবার আইনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ২০০৬ সালে বিসিএস উত্তীর্ণ ভাইয়ের জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আদায় করতে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রফা করে চরমপন্থীদের ধরিয়ে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল লিপটন।
সেনা অভিযানের দিনেও ভাই আলমগীর কবির উপস্থিত থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও ভাইকে দ্রুত মুক্ত করতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বলে স্থানীয়রা জানায়।
বহুবার গ্রেপ্তার হলেও মামলাকে দুর্বল, রিমান্ড আরামদায়ক, এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ অকার্যকর করে তোলার পেছনে ভাইয়ের ‘লবিং’ স্পষ্ট।
বিশেষ সম্পর্ক ও সামাজিক বৈধতা পাওয়ার কৌশল
সরকার পতনের পর গা ঢাকা দেন লিপটন। পরে, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকারের আত্মীয় দাবি করে স্থানীয় পরিষদসহ এলাকায় নিজেকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে।
বিএনপি নেতাদের নাম ব্যবহার করে নিজের অপরাধ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা, প্রশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং সামাজিক স্বীকৃতি পেতে তিনি সচেষ্ট ছিল। সরাসরি বিএনপির কোনো কমিটিতে তার নাম না থাকলেও, নতুন পরিস্থিতিতে দলের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে এবং নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেওয়ার কৌশলের অভিযোগ ছিল।
ত্রাসের রাজত্ব: জনগণের জীবনে প্রভাব
হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোরা ছিল লিপটনের নিত্যদিনের কার্যক্রম। মামলা দুর্বলকরণ, পুলিশ–প্রশাসনের তদবির, প্রশাসনিক ব্যবস্থা শিথিল রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভয় দেখানো ছিল তার অপরাধ-মূলকৌশল। সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ী ও প্রতিপক্ষের মাঝে ভয়, আতঙ্ক এবং জনজীবনে স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার আবহ চেপে বসে।
বহুবার মানববন্ধন, মিছিল ও স্মারকলিপি পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় লিপটন ছিল নিরাপদ।
গ্রেফতার এবং পরবর্তি
২০২৫ সালের ৬ জুন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইবি থানার দুর্বাচারা গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে একটি বিশেষ সেনা অভিযানে চরমপন্থি নেতা জাহাঙ্গীর কবির লিপটন গ্রেপ্তার হয়। অভিযানে তার সঙ্গে থাকা তিন সহযোগী এবং ৫টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।গ্রেপ্তারের পরেই তাকে অস্ত্র ও চরমপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব হেফাজতে নেওয়া হয় এবং পরে আদালতের আদেশে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। এসময় তার বিরুদ্ধে আগে দায়ের করা তিনটি হত্যা মামলায় শোন অ্যারেস্ট দেখানো হয় এবং তাকে কুষ্টিয়া কারাগার থেকে সরিয়ে ঝিনাইদহ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
শেষ কথা
লিপটন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, পারিবারিক ও অপরাধী নেটওয়ার্কের বহুমাত্রিক মেলবন্ধন। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়া, নেতাদের ব্যক্তিগত সখ্যতা, ভাইয়ের প্রশাসনিক প্রভাব, নিষিদ্ধ সংগঠনে নেতৃত্ব এবং অপরাধ সাম্রাজ্যের নিপুণ ব্যবস্থাপনায় তিনি দীর্ঘদিন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। এ ধরনের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অপব্যবহার অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারে দীর্ঘমেয়াদি বাধা তৈরি করেছিল।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩৪ বার পড়া হয়েছে