বাংলাদেশে চাঁদাবাজি ও আইনের শাসন সংকট: সর্বগ্রাসী অরাজকতা

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫ ৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দলীয় দখলদারিত্ব আজ রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে নৈরাজ্য ও গভীর শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী থেকে গ্রাম—হাট-বাজার, ফেরিঘাট, পরিবহন রুট, সরকারি নির্মাণ প্রকল্প, জলমহাল-বালুমহাল, এমনকি সীমান্ত ও পার্বত্য এলাকার প্রবেশপথেও চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের প্রভাব লাগামহীনভাবে বিস্তৃত হয়েছে। প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও আইনের প্রতি দায়বদ্ধতার সংকটের কারণে জনজীবন নিরাপত্তাহীণ, অর্থনীতি স্থবির এবং সামাজিক নৈতিকতা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ঢাকার মিটফোর্ডে চাঁদার জের ধরে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভিডিও ভাইরাল হওয়া সত্ত্বেও মূল পরিকল্পনাকারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে আইনের আওতার বাইরে। রাজধানীর পল্লবীতে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানে চাঁদা আদায়ের জন্য সশস্ত্র হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, যেখানে একজন কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হন—তবু, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি।
বিগত সপ্তাহে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির ভয়াবহতা নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। ঢাকা-শরীয়তপুর-গাবতলী-পদ্মা সেতু রুটে, প্রতি বাস ও ট্রাকের যাত্রাকালে একাধিক বার চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্লাজা ও আশপাশে ‘অফিশিয়াল স্লিপ’, প্রশাসনিক পরিচয় ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব দেখিয়ে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চলছে। শ্রমিক ও চালকদের কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মারধর, হুমকি কিংবা গাড়ি আটকের ঘটনা ঘটছে। পরিবহনখাতেই ঢাকায় প্রতিদিন আনুমানিক ২.২১ কোটি এবং সারা দেশে বছরে প্রায় ১,০৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।
বাজার ও হাটে পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও প্রতিদিন প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় চলছে, যার পেছনে স্থানীয় রাজনীতি ও তথাকথিত ব্যবসায়ী সংগঠনের ছত্রছায়া কাজ করছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই পণ্য সরবরাহ বন্ধ, ব্যবসা বন্ধের হুমকি কিংবা সরাসরি হামলার মুখোমুখি হতে হয়। সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, টেন্ডার, নির্মাণ, নদীপথের ইজারা থেকে শুরু করে বালুমহাল, জলমহাল—সবখানেই দলীয় ও প্রশাসনিক মদদপুষ্ট চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয়ের নির্দিষ্ট অংশ চাঁদা বা কমিশন হিসেবে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সীমান্ত অঞ্চলে সশস্ত্র চাঁদাবাজ চক্র বছরের পর বছর ধরে অবৈধ আদায়ে লিপ্ত। এই অঞ্চলে বছরে আনুমানিক ৪৫০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির হিসাব রয়েছে। সারা দেশ মিলিয়ে বাজার, ফেরিঘাট, পরিবহন, নির্মাণ ও ইজারা—সব মিলিয়ে কিছু নির্ভরযোগ্য অনুসন্ধানে বার্ষিক চাঁদাবাজির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় অনুসন্ধানে দেখা যায়, থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসনের একাংশ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মহল, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে এই দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করে। মামলায় তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা, “তদন্ত চলছে” অজুহাত, বিচারহীনতা ও প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকার চিত্র এখন চরমে। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আইনি সংকট জয় করতে পারেনি—কারণ কাগজপত্র, নির্দেশনা ও মাত্রাতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি।
এই বাস্তবতা দেশের ব্যবসায়ী, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ—সবাইকে অনিশ্চয়তা, ভীতি ও হতাশার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। বাজারের ন্যায্য মূল্য, নিরাপদ পরিবহন, বিনিয়োগকারী আস্থা, আইনের শাসন—সবই চাঁদাবাজ ও দখলদার সিন্ডিকেটের করায়ত্ত হয়ে পড়ছে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি আর প্রশাসনিক ব্যর্থতা অচিরেই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি আরো দুর্বল করে তুলবে, যদি না রাষ্ট্র বাহ্যিক ও আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগে দ্রুত শুদ্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩১ বার পড়া হয়েছে