সর্বশেষ

মতামত

কাগজে-কলমে কূটনৈতিক সৌজন্য, বাস্তবে অপমান

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, “ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি”

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫ ৩:৩৮ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে কূটনৈতিক সৌজন্য, সহযোগিতা ও সফ্ট ডিপ্লোমেসির আলোচনাই এখন যেন বেশি বেশি।

প্রতিবছর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম পাঠানো হয়—যা “ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি” নামে পরিচিত। এই রেওয়াজ শেখ হাসিনা সরকারের সময় শুরু হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারও তা অব্যাহত রেখেছে। কাগজে-কলমে এই সৌজন্য বিনিময় দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হলেও, বাস্তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র।

সীমান্তে রক্ত, কূটনীতিতে আম
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রতিদিন মানুষ হত‍্যা, এখানে প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও, কার্যকর কোনো সমাধান নেই। সীমান্ত হত্যা থাড়াও বর্তমানে অবৈধ পুশ-ইন একটা নতুন সংকট তৈরী করেছে। সেখানে রহিঙ্গা ও ভারতীয় মুসলিম বাঙালিদের জোর করে বাংলাদেশে পুশইন চালু করেছে। এছাড়াও পানি সংকট, উজানে বাঁধ খুলে আকস্মিক বন্যা—এসব সমস্যায় বাংলাদেশ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এসব বাস্তব সংকটের সমাধান না করেই, কূটনৈতিক সৌজন্যের নামে প্রতিবছর আম পাঠানো হয়। বাংলাদেশের জনগণের বেশিরভাগ মনে করেন—এই একতরফা নমনীয়তা ও প্রতীকী কূটনীতি বাস্তবে জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার প্রতিফলন ঘটায় না।

শেখ হাসিনা প্রসঙ্গ ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা
গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশের জনগণের বড় অংশ মনে করে, ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায়ই শেখ হাসিনা স্বৈরশাসন কায়েমের বড় সহায়ক ছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা এখন ভারতের সহযোগিতায় সেখান থেকেই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিতিশীল করা ও প্রভাব রাখার চেষ্টা করছেন। অনেকের বিশ্বাস, ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য হুমকি। এতে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আরও বেড়েছে।

অনুদান ও সহযোগিতার কাগুজে প্রতিশ্রুতি
ভারতের বাজেটে প্রতিবছর বাংলাদেশের জন্য অনুদান বরাদ্দ থাকে—২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২০০ কোটি রুপি, ২০২৪-২৫-এ ১২০ কোটি রুপি। কিন্তু বাস্তবে এই অর্থের পুরোটা কখনোই বাংলাদেশ পায়না। প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রকল্প অনুমোদনের ধীরগতিতে অর্থছাড় হয় সীমিত আকারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দের ৬০ ভাগ অর্থ ছাড় হয়েছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দের উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ছাড় হয়নি। নতুন কোনো বড় জনকল্যাণমূলক প্রকল্প শুরু হয়নি। অর্থাৎ, কাগজে-কলমে অনুদান থাকলেও, বাস্তবে “কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই”এটাই বাস্তবতা।

কূটনৈতিক সৌজন্য নাকি আত্মসমর্পণ?
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আম, শাড়ি, মিষ্টি, ইলিশ—এ ধরনের উপহার বিনিময়কে আন্তর্জাতিক ভাষায় “সফ্ট ডিপ্লোমেসি” বলা হয়। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কের বরফ গলানো, উত্তেজনা কমানো। কিন্তু যখন একতরফাভাবে বাংলাদেশ নমনীয়তা দেখায়, অথচ ভারত সীমান্ত হত্যা, পানি সংকট, আন্তর্জাতিক ফোরামে বিরোধিতা—এসব অব্যাহত রাখে, তখন জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ জন্ম নেয়। অনেকেই একে “নতজানু ডিপ্লোমেসি” বা আত্মসমর্পণমূলক কূটনীতি বলে মনে করেন। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় ও তার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ, বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

“ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি” কি শুধু ভারতের জন‍্য!
শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আম পাঠিয়ে (২০২১, ২০২৩) আম পাঠানোর ঐতিহ্যগত কূটনৈতিক রীতি চালিয়ে গেছে। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে আম পাঠানোর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তার “ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি” মূলত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সীমাবদ্ধ এবং পাকিস্তানের জন্য এমন কোনো উপহার পাঠানোর খবর নেই

জনগণের প্রত্যাশা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
বাংলাদেশের জনগণ চায়, কূটনৈতিক সৌজন্য ও সফ্ট ডিপ্লোমেসি হোক পারস্পরিক সম্মান ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। কাগজে-কলমে বরাদ্দ, প্রতীকী উপহার বা শুভেচ্ছা বিনিময়—এসব তখনই অর্থবহ, যখন বাস্তবে সীমান্ত হত্যা, পানি সংকট, অর্থছাড় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি আসে। না হলে, এই কূটনীতি কেবল আত্মমর্যাদাহীনতার প্রতীক হয়ে থাকে।

আমার কথা
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান বাস্তবতা হলো—কাগজে কূটনৈতিক সৌজন্য ও অনুদান থাকলেও, বাস্তবে অপমান, ক্ষতি ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অভাব। ভারতে গোপনে আম উপহার পাঠিয়ে সরকারের যে “ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি” তখনই কার্যকর হবে, যখন তা পারস্পরিক সম্মান ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে হয়। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও সীমান্ত সমস্যার সমাধানহীনতা—সব মিলিয়ে একতরফা নমনীয়তা ও প্রতীকী কূটনীতি জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করতে পারছে না—এটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের জনগণের (*ম্যাঙ্গো পিপুল) হতাশা ও প্রতিবাদের মূল কথা ভারতের সাথে নতজানু নয়, চোখে চোখ রেখে কুটনৈতিক অবস্থান তৈরী করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট 

২৩০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন