গুম কমিশনের প্রতিবেদন: নারকীয় নির্যাতনের শিকার নারীরা

বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫ ১১:১৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সরকারি বাহিনীর দ্বারা গুম ও গুম-পরবর্তী নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র উঠে এসেছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
মঙ্গলবার কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রতিবেদনটির অংশবিশেষ সরবরাহ করা হয়। এতে উঠে এসেছে র্যাব, সিটিটিসি ও ডিজিএফআই-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মর্মান্তিক অভিযোগ।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি নারী ভুক্তভোগীরাও। এক ২৫ বছর বয়সি নারী জানান, ২০১৮ সালে তাকে ২৪ দিন গুম করে রাখা হয়েছিল। পুলিশ তাকে অপহরণ করে ‘ক্রুশবিদ্ধ’ করার মতো করে ঝুলিয়ে রাখে। ওড়না খুলে তাকে জনসম্মুখে উন্মুক্ত রাখা হয়, জানালার ফাঁক দিয়ে পুরুষ সদস্যরা হাসাহাসি করত এবং কটূক্তি ছুড়ত।
তিনি আরও বলেন, "তারা এমনভাবে নির্যাতন করেছিল যে আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। তখন আমি প্যাড চাইলে, তারা হাসতে হাসতে উপহাস করত।"
কমিশনের তথ্যমতে, গুমের শিকারদের রাখা হতো শব্দনিরোধক কক্ষে—যেখানে তাদের আর্তনাদ বাইরের কেউ শুনতে পেত না। নির্যাতনের আনুষ্ঠানিক কোনো রেকর্ড না থাকায়, নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্বমুক্তভাবে ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতে নির্যাতন চালাতে পারত। জনসম্মুখে আনার আগে তাদের ক্ষতস্থানে ওষুধ মেখে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে ফেলারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
একাধিক ভুক্তভোগীর বর্ণনায় উঠে এসেছে বৈদ্যুতিক শক, আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা, চোখ বেঁধে শারীরিক নির্যাতন, এমনকি পা বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে পেটানোর মতো নৃশংস কৌশলের কথা। এক ৪৭ বছর বয়সি ব্যক্তি জানান, “মনে হতো আমার হাড় ভেঙে যাবে। তারা হুমকি দিত, হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবে।”
আত্যাচারের মাত্রা বেশি হওয়ায় অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বমি করে দিতেন, আবার কেউ কেউ চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন।
র্যাব-১১ কর্তৃক গুম হওয়া এক যুবকের ভাষ্য, “আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। পরে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি, এমনকি প্রস্রাবের সময়ও বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।” অপর এক ভুক্তভোগী জানান, “আঙুলে প্লাস দিয়ে ধরেছে, সুঁচ ঢুকিয়েছে। গোপনাঙ্গেও শক দেওয়া হতো।”
কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষভাবে তৈরি শব্দনিরোধক কক্ষ, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, ঝুলানোর পুলি সিস্টেম ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থার সঙ্গে ভুক্তভোগীদের বিবরণ মিলিয়ে দেখা গেছে।
এক ৪৬ বছর বয়সি ব্যক্তি যিনি ৩৯১ দিন গুম অবস্থায় ছিলেন, তিনি জানান, সেলগুলো ছিল এতটাই ছোট ও নোংরা যে প্রাকৃতিক কাজের স্থান ও ঘুমানোর জায়গা ছিল একই। সেখানে কোনো দেয়াল ছিল না, এবং সবসময় নজরদারির সিসিটিভি ছিল সক্রিয়।
২০১০ সালে র্যাবের হাতে ৪৬ দিন গুম থাকা একজন জানান, “আমার পায়ে ক্লিপ লাগিয়ে বারবার বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। শরীর গোল হয়ে যেত। এমনকি গোপনাঙ্গেও একই কায়দায় শক দিত।”
গুমের শিকারদের অধিকাংশ জানিয়েছেন, গুমকারীরা এখনো দাপ্তরিকভাবে কর্মরত আছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিচার হয়নি, বরং তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের আশঙ্কা—এমন দায়মুক্তির সংস্কৃতি থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে দেশ এগিয়ে যাবে।
কমিশনের এ প্রতিবেদন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এদিকে ফেরানো এবং বিচার নিশ্চিত করার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
১৪৮ বার পড়া হয়েছে