প্রবাসী শ্রমিক ও উগ্রবাদ: সময়মতো কঠোর পদক্ষেপই ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারে

বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫ ২:৩৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স।
বিদেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকের পরিশ্রমে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে এবং তাঁদের পরিবারগুলোও জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। তবে সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ৩৬ জন বাংলাদেশির আইএস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা এই শ্রমশক্তিকে ঘিরে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, এই ব্যক্তিরা কট্টর জঙ্গি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে সেল গঠন, কর্মী নিয়োগ এবং তহবিল সংগ্রহে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ হয়েছে এবং বাকি ১৬ জন তদন্তাধীন।
এ ঘটনা নিছক আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘনের বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সুনাম এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে এক বড় ধরনের হুমকি। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সেই অবস্থানের গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
বিদেশি শ্রমবাজারের সামনে ঝুঁকি
মালয়েশিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি বৈধভাবে কাজ করছেন। তাঁদের নিরলস শ্রম বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনস্বীকার্য অবদান রাখছে। কিন্তু কিছু লোকের উগ্র কর্মকাণ্ডের ফলে সমগ্র প্রবাসী সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হলে, তা বৈধ শ্রমিকদের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। নিয়োগকর্তারা আরও কঠোর হয়ে উঠতে পারেন, যার প্রভাবে রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
উগ্র মতাদর্শ তরুণদের মধ্যে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক মোহ তৈরি করে, যা যুক্তি-বিবেচনার বাইরে চলে যায়। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় তারা জঙ্গিবাদকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। এই বিপথগামী ধারণা শুধু একজন শ্রমিককে বিপন্ন করে না; তাঁর মাধ্যমে গড়ে ওঠা সেল গোটা কমিউনিটিকে বিপদে ফেলতে পারে।
প্রতিরোধে চাই শক্তিশালী ব্যবস্থা
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে বিদেশগামী শ্রমিকদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় আরও কঠোর হতে হবে। শুধু পাসপোর্ট বৈধ হলেই কেউ যেন বিদেশে যেতে না পারেন। তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক অতীত এবং আচরণগত দিক বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়ন করা জরুরি।
এছাড়াও প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা, আইন মেনে চলার সংস্কৃতি ও জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে দূতাবাস ও কমিউনিটি নেতাদের বড় ভূমিকা নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে দূতাবাসগুলোকে প্রবাসীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং যেকোনো সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষ করে, যাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক। অভিযোগ সত্য হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে প্রয়োজনে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে
বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং উগ্রবাদ থেকে দূরে থাকার গুরুত্ব বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই প্রশিক্ষণে মনোবিজ্ঞানী, আইনজ্ঞ ও উদার ধর্মবিশারদদের সম্পৃক্ত করা উচিত। এতে শ্রমিকদের মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হবে এবং উগ্র মতাদর্শের প্রলোভনে পা না দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেছে, বহু সন্ত্রাসী সংগঠনের ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, উগ্রবাদের বীজ এখনো সমাজের ভেতরে সক্রিয় এবং এখন তা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে।
রাষ্ট্রের দৃঢ় অবস্থান এখন সময়ের দাবি
যদি বাংলাদেশি শ্রমিকদের নামের পাশে ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার’ ট্যাগ লাগানো শুরু হয়, তাহলে শুধু মালয়েশিয়া নয় মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা ও নিয়োগে বিধিনিষেধ আসতে পারে। এতে করে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ভয়াবহভাবে ব্যাহত হতে পারে।
এই বাস্তবতায় শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না। সরকারকে দৃঢ়, সুপরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে ও বিদেশে সক্রিয় উগ্রপন্থীদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে নাগরিকত্ব বাতিল, সম্পত্তি জব্দ এবং আজীবনের জন্য বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর আইন প্রণয়নও বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
এখন আর গড়িমসি করার সময় নেই। ‘মেরুদণ্ডহীন নমনীয়তা’ নয়, চাই দৃঢ়তা ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। নইলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, বৈদেশিক নীতিমালা এবং অর্থনীতির ভিত্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি মাত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা গোটা জাতিকে কলঙ্কিত করতে পারে।
১৩৭ বার পড়া হয়েছে