সর্বশেষ

আন্তর্জাতিক

মানবতার পরাজয়: গাজায় ত্রাণকর্মী, সাংবাদিক, নারী-শিশু কেউই নিরাপদ নয়

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫ ৯:৫০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান বর্বরতায় নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

প্রতিদিনের বোমা হামলা, নির্বিচার গুলি, খাদ্য সরবরাহে বাধা এবং ত্রাণকেন্দ্রে হামলার ফলে গাজা এখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। যুদ্ধবিরতির কোনো লক্ষণ নেই, বরং প্রতিদিন বেড়েই চলেছে হতাহতের সংখ্যা, বাড়ছে দুর্ভোগ ও ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ।

নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে গাজায় নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪,৪৮৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৪,৫০০ শিশু ও ৯,৫০০ নারী। প্রতিদিন গড়ে ৬৩ জন নারী, যার মধ্যে ৩৭ জন মা, এবং ১৭,০০০ শিশু এতিম হচ্ছে। এই সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে। হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নির্বিচারে হামলায় শিশুদের চিরতরে স্কুল, পরিবার ও নিরাপত্তা হারিয়ে গেছে। জাতিসংঘের ভাষায়, “গাজার শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়েছে—শিক্ষা নেই, নিরাপত্তা নেই, শুধু বেঁচে থাকার লড়াই”।

খাদ্য সরবরাহে বাধা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা
ইসরায়েলি অবরোধ ও হামলার কারণে গাজায় বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ খাদ্য সংকট চলছে। প্রায় ২১ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে; অর্ধলক্ষ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। মার্চ ২০২৫ থেকে ইসরায়েল সব ধরনের ত্রাণ ও খাদ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয়, যার ফলে শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে, মায়েরা সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, “গাজায় মানুষ এখনই অনাহারে মারা যাচ্ছে, অথচ সীমান্তের ওপারে খাবার ও ওষুধ পড়ে আছে”।

ত্রাণকেন্দ্রে হামলা: বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও ধ্বংস
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যারা বেঁচে আছেন, তারা আশ্রয় ও খাবারের জন্য ত্রাণকেন্দ্রের দিকে ছুটছেন। কিন্তু সেই আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, মসজিদ, এমনকি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আলজাজিরার তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে অন্তত ৫৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪,০৬৬ জন। এমনকি শিশু ও নারীরাও ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন। গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান এলাকার একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর ওপর হামলায় ৯ জন নিহত হয়, খান ইউনুসের ত্রাণকেন্দ্রের পাশে আরও ৯ জন প্রাণ হারান।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার ৯০ শতাংশ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়েছে; ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাও রেহাই পায়নি। জাতিসংঘের তদন্তে উঠে এসেছে, এসব স্থাপনায় হামলা পরিকল্পিত এবং যুদ্ধাপরাধের শামিল। শিশুদের ভবিষ্যৎ, শিক্ষার অধিকার, সংস্কৃতি—সবকিছুই ধ্বংসের মুখে।

যুদ্ধবিরতির আহ্বান অগ্রাহ্য
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরায়েল আরও ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, “এটি কেবল যুদ্ধ নয়, বরং একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা”। ত্রাণকর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক—কেউই নিরাপদ নন।

হৃদয়বিদারক চিত্র
একজন মায়ের আর্তনাদ—“আমার সন্তান ক্ষুধায় কাঁদছে, আমি কিছুই দিতে পারছি না। আশ্রয়কেন্দ্রেও নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিন মৃত্যুর ভয় নিয়ে ঘুমাই।”
এক শিশুর কণ্ঠে, “আমার স্কুল নেই, বন্ধু নেই, বাবা-মা নেই। শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা।”
গাজার মানুষের এই অবর্ণনীয় দুর্দশা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত এই মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে—এটাই বাস্তবতা। গাজার আকাশে এখনও ধোঁয়া, মানুষের মুখে ক্ষুধা আর চোখে মৃত্যুভয়। মানবতা আজ এখানে পরাজিত।

শেষ কথা
বিশ্বের বিবেক আজ প্রশ্নবিদ্ধ—মানবাধিকারের কথা বলা সভ্যতা কেন এই গণহত্যা থামাতে ব্যর্থ? শিশুদের কান্না, মায়েদের আর্তনাদ আর ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া স্বপ্নের কাছে আমাদের নীরবতা কি ইতিহাস ক্ষমা করবে?
এখনই সময়, মানবতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর। গাজার এই গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। যেন আর কোনো শিশু ক্ষুধায়, কোনো মা সন্তানের লাশ বুকে জড়িয়ে, কোনো পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রেও মৃত্যুর আশঙ্কায় দিন না কাটায়।

লেখক:  সাংবাদিক, কলামিস্ট 

১৬৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন