পানি কূটনীতিতে নতুন মোড়: বাংলাদেশের দিকে ভারতের দৃষ্টি

শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫ ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি কার্যত স্থগিত করার পর এবার ভারত তার দৃষ্টিপাত করেছে বাংলাদেশের দিকে।
১৯৯৬ সালের ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিকে ঘিরে ভারতের তরফ থেকে এসেছে পুনর্বিবেচনার বার্তা যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে এক নতুন মোড় তৈরি করতে পারে।
ভারতের দাবি, কৃষিকাজ, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনার জন্য তাদের এখন অতিরিক্ত ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ কিউসেক পানির প্রয়োজন। ফলে দিল্লির ধারণা, বর্তমান চুক্তি তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। সেই প্রেক্ষাপটে ভারত ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য স্বল্পমেয়াদি ও পর্যায়ক্রমিকভাবে সংশোধনযোগ্য একটি নতুন চুক্তির প্রস্তাব বিবেচনা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক ধরনের কৌশলগত চাপ প্রয়োগের কৌশল যেখানে পানি, ভূরাজনীতি ও অর্থনীতি একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
চুক্তির কাঠামো ও ভারতের আপত্তি
১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির আওতায়, প্রতি বছর ১১ মার্চ থেকে ১১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারেজের প্রবাহ ১০ দিন অন্তর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভাগ করা হয়।
যদি প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে আসে, তাহলে উভয় দেশ সমানভাবে পানি ভাগ করে।
৭০–৭৫ হাজার কিউসেক হলে বাংলাদেশ পায় ৩৫,০০০ কিউসেক।
তার চেয়ে বেশি হলে ভারত নেয় ৪০,০০০ কিউসেক, বাকি দেয় বাংলাদেশকে।
বর্তমানে ভারত মনে করছে, এই ফর্মুলা তাদের নতুন চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশের প্রায় ৬০% আবাদযোগ্য জমি গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এই পানির সরবরাহে সামান্য অনিশ্চয়তাও খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ভারতের এই অবস্থান বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
ফারাক্কা ব্যারেজ বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সুবিধা, যা এখন সম্পর্কের আলোচনায় চাপ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন
চুক্তি পুনর্বিবেচনার প্রস্তাবের পাশাপাশি ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকেও আলোচনায় আনা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও রংপুর অঞ্চলকে “চিকেন নেক” হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে—একটি ভূরাজনৈতিক দুর্বলতা, যেটি আগে বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। এতে বোঝা যায়, উভয় দেশ একে অপরের ভৌগোলিক স্পর্শকাতরতা নিয়ে কৌশলগত তাস খেলছে।
নতুন বাস্তবতা
এক সময়ের সেতুবন্ধন হয়ে ওঠা গঙ্গা নদী এখন কৌশলগত চাপ ও জলনীতি নির্ভর সমীকরণের অংশ হয়ে উঠেছে। উৎস দেশের হাতে নদীর দিকনির্দেশনা থাকার অর্থ এখন শুধু প্রাকৃতিক আধিপত্য নয়, বরং কূটনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম।
২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বাংলাদেশ কী অবস্থান নেয়, তা নির্ধারণ করবে শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয় দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণও।
১২১ বার পড়া হয়েছে