চন্দ্রদ্বীপের বালিয়াতলীর শতবর্ষের আধ্যাত্মিক ধারা ও ঐতিহ্য

শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫ ৬:৪৬ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের বালিয়াতলী গ্রাম।
বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর নদী বিধৌত চরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নিভৃত এই জনপদ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের জন্য। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিখ্যাত "গাউছুল আজম খানকা শরীফ" যেখানে পদচারনায় মুখর ছিলো বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) এর বংশধর হযরত শাহ সুলতান সৈয়দ বোগদাদী (রাহ:) এর। "খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) মসজিদ কমপ্লেক্স" এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত "বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসা"।
ঐতিহাসিক নথিপত্র, পুরোনো সরকারি দলিল এবং প্রবীণদের সাক্ষ্য অনুসারে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন ও কার্যক্রম নিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাড়ছে জানার ব্যাপক আগ্রহ।
ঐতিহাসিক সূত্র: দলিল-দস্তাবেজে খানকার ইতিহাস- উপজেলার জমি সংক্রান্ত পুরোনো নথিপত্রে পাওয়া গেছে ১৮৯৫ সালের দিকে গাউছুল আজম খানকা শরীফ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ। বালিয়াতলি মৌজার তৎকালীন ভূমি রেকর্ড অনুসারে খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এর নামে খানকা পরিচালনার জন্য একখণ্ড জমি দানপত্রের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট করা হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্র জানায়, খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এর নামে একটি "ওয়াকফ" দলিল" ১৯০০ সালের শুরুতেই বা তারও আগে রেজিস্ট্রার অফিসে জমা হয়, যার দলিল নং এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।
মসজিদ কমপ্লেক্স: ওয়াকফ নথিতে পরিষ্কার উল্লেখ- খানকার পাশাপাশি ১৯০০ সালে র শুরুতে গড়ে ওঠে মসজিদ কমপ্লেক্স, যার ভিত্তি রচনার সময় একটি আলাদা ওয়াকফ দলিল সম্পাদিত হয় খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ) এর সহধর্মিনী মহীয়সী ছাহের জান বিবির সম্পত্তির মাধ্যমে । চরগাছিয়ার প্রবীণ বাসিন্দা মরহুম হোসাইন মেম্বার জানান, তাঁর দাদার কাছে থাকা হাতে লেখা একটি পুরোনো দলিলে মসজিদ কমপ্লেক্সের জমি দান ও নির্মাণের বিবরণ পাওয়া যায়। ওই দলিলে 'খাজা ফয়েজ উদ্দিন খানকা শরীফ ও জামে মসজিদের জন্য দানকৃত জমি'—এই ভাষায় সম্পত্তির বিবরণ রয়েছে।
বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসার স্থানান্তর সংকট: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদার লড়াই
বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনা জেলার বালিয়াতলী গ্রাম দীর্ঘদিন ধরে আধ্যাত্মিক সাধনা, সমাজকল্যাণ এবং শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। বিশেষ করে বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এবং তাঁর সাধক ও বুজুর্গ পুত্র হযরত খাজা নাছের আলী (রহঃ) এর হাতে গড়ে ওঠা খানকা শরীফ, মসজিদ কমপ্লেক্স ও দাখিল মাদ্রাসা আজও এই এলাকার ঐতিহ্যের স্মারক।
তবে এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া এক ছাপ ফেলেছে। পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রশ্নে ঘটে যাওয়া এই সংকট নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে আছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৭২ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র কয়েক মাসের মাথায়, দেশ যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক সংকট ও শিক্ষার অভাবে জর্জরিত, তখন খাজা নাছের আলী (রহঃ) পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন "বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসা"। যা আলিয়া মাদ্রাসা হিসেবে উন্নীত করার আগে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা হিসেবে অত্র অঞ্চলে সুখ্যাতি অর্জন করে। এটি ছিল তাঁর পিতা হযরত খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এর নামে ঈসালে সওয়াবের জন্য উৎসর্গকৃত একটি শিক্ষা-উদ্যোগ, যা এলাকার দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া একটি বিখ্যাত ফোরকানিয়া মাদ্রাসা।
স্থানান্তরের ঘটনাপ্রবাহ- স্বাধীনতা-পরবর্তী আর্থিক সংকট এবং ব্যক্তিগত সুবিধার লোভ থেকে খাজা নাছের আলী (রহঃ) এর আপন ছোট ভাই মৌলভী শামসুল হক সাহেব একপক্ষীয়ভাবে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বড় ভাই ও প্রতিষ্ঠাতা মোতোয়াল্লী খাজা নাছের আলী (রহঃ) এর অনুমতি ছাড়াই দক্ষিণ চরগাছিয়া এলাকার আফতাব উদ্দিন খান সাহেবের সাথে গোপনে সলা পরামর্শ করেন এবং মাদ্রাসার সকল কাগজপত্র, নথিপত্র এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আফতাব উদ্দিন সাহেবের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে মূল কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ চরগাছিয়া, আফতাব উদ্দিন সাহেবের ব্যক্তিগত বাড়িতে। এই পদক্ষেপ ছিল পরিবার, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত।
পারিবারিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া: ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই খাজা নাছের আলী (রহঃ) গভীরভাবে মর্মাহত হন। শুধু পারিবারিক ঐক্য নয়, বরং বংশপরম্পরায় গড়ে ওঠা আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাগত ঐতিহ্যকে হস্তান্তরের ঘটনায় তিনি ছোট ভাইয়ের উপর প্রচণ্ড অভিমান পোষণ করেন। তাঁর ভাষায়, "পিতার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা কোনো ব্যক্তির স্বার্থের বলি হতে পারে না।" এ আঘাত ও মানসিক যন্ত্রণায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘদিন রোগভোগ করেন। পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা বলেন, এই ঘটনার পর খাজা নাছের আলী (রহঃ) মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন।
ছারছিনা শরীফের পীর সাহেবের হুঁশিয়ারি-এ ঘটনায় শুধু পরিবারে নয়, বরং আধ্যাত্মিক মহলেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ছারছিনা শরীফের তৎকালীন পীরে কামেল, বিখ্যাত সুফি সাধক শাহ সুফি হযরত মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহঃ) ঘটনা শুনে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি অএ এলাকায় মাহাফিলে গিয়ে দৃঢ় ভাষায় ঘোষণা করেন—“এই মাদ্রাসাটি এখানে থাকবে না, আমি এর নাম এখান থেকে কেটে দিয়ে গেলাম।” সেই সময় তাঁর এই বক্তব্য স্থানীয় জনগণের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং আধ্যাত্মিক মহলে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।
ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার: আল্লাহর ইচ্ছা ও আধ্যাত্মিক সত্যের শক্তিতে এর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছারছিনা শরীফের পীর সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। দক্ষিণ চরগাছিয়ায় আফতাব উদ্দিন সাহেবের বাড়িতে মাদ্রাসা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা, সমাজের প্রতিবাদ এবং শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের কারণে অচিরেই মাদ্রাসাটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ, খাজা পরিবারের উদ্যোগ এবং আধ্যাত্মিক মহলের সহায়তায় মাদ্রাসাটি তার প্রকৃত অবস্থানে, অর্থাৎ খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এর বাড়ি সংলগ্ন জমিতে পুনঃস্থাপিত হয়। সেখানেই আজও প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসার এই স্থানান্তর সংকট শুধু পারিবারিক বিরোধ বা জমি সংক্রান্ত ঘটনা নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, পারিবারিক মর্যাদা এবং সমাজে সত্য ও ন্যায়ের লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য কখনও দীর্ঘ সময় টিকতে দেয়নি। সত্য, ন্যায় ও ঐতিহ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী—এই শিক্ষাই দিয়ে গেছে চরগাছিয়ার শতবর্ষের এই ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধের পর শিক্ষার নতুন আলো: দাখিল মাদ্রাসার দলিল ও প্রমাণ-১৯৭২ সালে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক মাস পরই খাজা নাছের আলী (রহঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক ও সমাজকল্যাণের দায়িত্বকে সম্প্রসারিত করেন শিক্ষাক্ষেত্রে। বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির নথি অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে তৎকালীন শিক্ষা বোর্ডে মাদ্রাসার অনুমোদনের জন্য আবেদন জমা হয়। জেলা শিক্ষা অফিসের আর্কাইভ থেকে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসাটি দাখিল পর্যায়ের স্বীকৃতি লাভ করে।
স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, "দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই চরাঞ্চলে শিক্ষার যে ভয়াবহ ঘাটতি ছিল, সেই সংকট কাটাতে খাজা নাছের আলী (রহঃ) এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ছিল ঐ সময়ের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। এখান থেকে কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ধর্মীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞান অত্র অঞ্চলের সকলের ধর্মীয় চেতনা বোদকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
প্রবীণদের সাক্ষ্য: ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে- অত্র এলাকার প্রবীণ মরহুম আব্দুল গনি আকন (৮২) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন, "আমি ছোটবেলায় দেখছি, আমাদের এলাকায় খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) এর খানকা ছিল মানুষের আস্থার জায়গা। অসুস্থ হলে মানুষ দোয়া নিতে আসতো, ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা হতো, এমনকি রাতের বেলায় খানকায় আধ্যাত্মিক তালিম তালকিন, ধর্মীয় হামদ-নাতেরও আয়োজন হতো।"
তিনি আরও জানান, "খাজা নাছের আলী (রহঃ) শুধু বাবার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান দেখভাল করেননি, নতুন করে বাবার প্রতিষ্ঠিত অঞ্চল ভিত্তিক ফোরকানিয়া মাদ্রাসাকে আলিয়া মাদ্রাসায় রূপান্তরের ও সরকারি অনুমোদনের গভীর প্রয়াস ও জনমত গড়ে তুলেছেন। তার বিচার ব্যবস্থা ছিল ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক, তিনি ব্যক্তি জীবনে খুব দৃঢ় ও কঠোর শক্তিমান মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শিক্ষা ছড়ানো যে কত বড় প্রয়োজন ছিল, সেটা তিনি গভীরভাবে অন্তর দিয়ে বুঝেছিলেন।"
বর্তমানে খাজা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিয়মিত খানকা পরিচালনা (যেখানে পাঙ্গাসিয়া দরবার শরিফের পীর ছাহেব কেবলা) তাশরিফ এনে থাকেন, মসজিদ কমপ্লেক্স সম্প্রসারণ এবং মাদ্রাসার উন্নয়নমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যা খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এর যোগ্য উত্তরসূরী ও দৌহিত্র মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মাদ ইসমাইল ছাহেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বালিয়াতলী চরগাছিয়া দাখিল মাদ্রাসাকে ভবিষ্যতে সাইন্স সহ আলিয়ার উচ্চতম স্তরে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছে।
পুরোনো জমির রেকর্ড, ওয়াকফ দলিল, শিক্ষা বোর্ডের নথি এবং প্রবীণদের স্মৃতি মিলিয়ে স্পষ্ট হয়—নবাব খাজা আহসানুল্লাহর যোগ্য উত্তরসূরী ও আধ্যাত্মিক তাপস খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহঃ) ও খাজা নাছের আলী (রহঃ) এর নেতৃত্বে বরগুনা জেলার (নবাবী স্টেটের আওতায় আয়লা-টিয়াখালি ও ফুলঝুরি অঞ্চলের) আমতলী থানার আরপাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নে বালিয়াতলী অঞ্চলে যে আধ্যাত্মিক ও শিক্ষামূলক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা আজও বহমান। নতুন প্রজন্ম শুধু ইতিহাস জানছে না, বরং তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় এ ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ হওয়ার আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
১০৮ বার পড়া হয়েছে