শব্দদূষণ: আইন আছে, কার্যকর নেই—জনস্বাস্থ্য ও নাগরিক জীবনে নীরব বিপর্যয়

শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০২৫ ১:৩৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের নগরজীবনে শব্দদূষণ এখন এক নীরব মহামারির নাম।
যানবাহনের হর্ন, নির্মাণকাজ, কলকারখানা, সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এমনকি পণ্য বিক্রির প্রচারণা—সবখানেই উচ্চ শব্দের অবাধ ব্যবহার। অথচ, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে দেশে স্পষ্ট আইন, জরিমানার বিধান ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইন কার্যত অকার্যকর। নাগরিক জীবনে শব্দদূষণের ভয়াবহতা, আইনের দুর্বল বাস্তবায়ন এবং সমাধানের পথ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুলে ধরছি।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও নীরব এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালতের সামনে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ এবং নির্মাণকাজে নির্দিষ্ট সময় ও মাত্রার বাইরে উচ্চ শব্দ উৎপাদন আইনত দণ্ডনীয়। উচ্চ শব্দের মাইক ব্যবহারে অনুমতির বাধ্যবাধকতা আছে। এমনকি, ড্রাইভিং লাইসেন্সে পয়েন্ট কাটা ও লাইসেন্স বাতিলের বিধানও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এসব আইন ও বিধিমালা প্রায় কোথাও মানা হচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কে হর্নের অপব্যবহার, আবাসিক এলাকায় মাইকের প্রচারণা, নির্মাণকাজের যান্ত্রিক শব্দ—সবই চলছে নির্বিঘ্নে।
আইনের দুর্বল বাস্তবায়ন—মূল সংকট
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অদক্ষতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, জনবল সংকট ও প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা আইনের বাস্তবায়নে বড় বাধা। অধিকাংশ থানায় শব্দ মিটার নেই, পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল অপ্রতুল, আর ট্রাফিক পুলিশ শব্দদূষণকে অগ্রাধিকার দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে আইন প্রয়োগকারীরা ব্যবস্থা নেন না। জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ অপর্যাপ্ত—অপরাধীরা সামান্য জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়। মোবাইল কোর্টের অভিযানও অনিয়মিত ও ইভেন্টনির্ভর। ফলে, আইন আছে—কিন্তু তার কার্যকারিতা নেই।
স্বাস্থ্য ও শিশুদের বিকাশে মারাত্মক প্রভাব
শব্দদূষণের কারণে শিশুদের মেধা বিকাশে বাধা, শিক্ষায় মনোযোগহীনতা, আচরণগত সমস্যা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক চাপসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। স্কুল, হাসপাতাল, আদালতের মতো নীরব এলাকায়ও শব্দদূষণ রোধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। নির্মাণকাজে উচ্চ শব্দের কারণে আশপাশের শিশু, রোগী ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নাগরিক উদাসীনতা ও সচেতনতার অভাব
আইন না মানার পেছনে জনসচেতনতার অভাবও বড় কারণ। চালক, ব্যবসায়ী, নির্মাতা—অনেকে শব্দদূষণের ক্ষতি জানেন না বা গুরুত্ব দেন না। আবাসিক এলাকায় মাইকিং, উচ্চ শব্দে পণ্য বিক্রি, নির্মাণকাজ—সবই স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ কম আসে, প্রতিবাদও দুর্বল—ফলে প্রশাসনও উদাসীন থাকে।
সমাধানের পথ—কঠোর আইন প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ
শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রশাসনিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তি ব্যবহার, জনবল ও মনিটরিং বাড়ানো, জরিমানার হার বৃদ্ধি, লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি থানায় শব্দ মিটার, শহরে নয়েজ মনিটরিং সিস্টেম, যানবাহনের ফিটনেসে শব্দমাত্রা পরীক্ষা বাধ্য
তামূলক করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচারণা জরুরি। নগর পরিকল্পনায় সবুজ বেষ্টনী, সাউন্ডপ্রুফিং ও নীরব এলাকা চিহ্নিতকরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য হেল্পলাইন ও পরিবেশ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।
এখনই যা করণীয়
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ঢাকা শহরকে বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষিত শহর এবং রাজশাহীকে চতুর্থ স্থানে রাখা হয়েছে। ঢাকায় শব্দের গড় মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল, রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল—যেখানে আবাসিক এলাকায় অনুমতিযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল। এমনকি ঢাকার নীরব এলাকায়ও শব্দের মাত্রা নির্ধারিত সীমার আড়াই গুণ বেশি। অথচ, ৮০-৮৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দে দীর্ঘ সময় থাকলে মানুষ স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে, ১২০ ডেসিবেল শব্দে অল্প সময়েই কান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমার কথা
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন ও প্রযুক্তি আছে—কিন্তু বাস্তবায়নের সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নাগরিক সচেতনতা ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে—নইলে শব্দদূষণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন—এটাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১০৭ বার পড়া হয়েছে