সর্বশেষ

মতামত

ফোর্ডো হামলা: যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়, নাকি ইরানের কৌশলগত জয়?

মনজুর এহসান চৌধুরী 
মনজুর এহসান চৌধুরী 

বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫ ৩:১৬ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের ২২ জুনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বাঙ্কার বাস্টার বোমা দিয়ে হামলা চালায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেন, এসব স্থাপনা “পুরোপুরি ধ্বংস” হয়েছে। কিন্তু স্যাটেলাইট চিত্র, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন ও তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, “ধ্বংস” এবং “ক্ষতি”—এই দুই শব্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, এবং “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হওয়ার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। তদুপরি, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি।

স্যাটেলাইট চিত্র ও ধ্বংসের পরিমাণ
হামলার পর স্যাটেলাইট চিত্রে ফোর্ডোর পাহাড়ের উপরে ছয়টি বড় গর্ত, প্রবেশপথ ধ্বংস, বিস্ফোরণের ছাই ও মাটির রঙের পরিবর্তন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এসব চিত্র “significant damage” বা “extremely severe damage”-এর প্রমাণ দেয়। প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থাপনাটির ভেতরে প্রবেশ আপাতত অসম্ভব হয়েছে, তবে ভবিষ্যতে ইরান চাইলে নতুন করে খনন বা ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে পুনরুদ্ধার করতে পারবে—এটা কোনো স্থায়ী বা চিরস্থায়ী ধ্বংস নয়।
তবে, স্যাটেলাইট চিত্রের সীমাবদ্ধতা হলো—এতে কেবল বাইরের ক্ষতি দেখা যায়, গভীর ভূগর্ভস্থ মূল পারমাণবিক স্থাপনার ভেতরের ধ্বংসের মাত্রা নির্ভরযোগ্যভাবে বোঝা যায় না। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) ও বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, “ভেতরের ক্ষতির মাত্রা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি”—এটা অনুমানমূলক, নিশ্চিত নয়।

তেজস্ক্রিয়তা: প্রমাণ ও ঝুঁকি
______________________-
হামলার পরপরই IAEA, ইরান এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নিশ্চিত করেছেন, ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—কোনো স্থাপনাতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েনি।
IAEA মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “কোনো সাইটের বাইরের পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়েনি”।
এনপিআর ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তেজস্ক্রিয়তা ও রাসায়নিক দূষণ মূলত স্থাপনার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, আশপাশের পরিবেশ বা জনগণের জন্য কোনো তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব স্থাপনায় স্বল্পমাত্রার ইউরেনিয়াম ছিল, যা বিস্ফোরণে ছড়িয়ে গেলেও বাইরের পরিবেশে বড় ধরনের তেজস্ক্রিয় ঝুঁকি তৈরি করে না। এমনকি ফোর্ডোতে কোনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়ালেও, তা মূলত “লো-লেভেল আলফা রেডিয়েশন”—যা কেবল সরাসরি সংস্পর্শে এলে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং যথাযথ সুরক্ষা থাকলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

“ধ্বংস” বনাম “ক্ষতি”: শব্দের গুরুত্ব
————————————
সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণে “ধ্বংস” (destroyed) শব্দটি ব্যবহার করতে হলে নির্ভরযোগ্য, সরাসরি ও স্বাধীন প্রমাণ প্রয়োজন—যেমন সরাসরি পরিদর্শন, অভ্যন্তরীণ ছবি, বা নিরপেক্ষ সংস্থার তদন্ত। কেবল বাইরের গর্ত বা প্রবেশপথ ধ্বংসের প্রমাণ দিয়ে “পুরো স্থাপনা ধ্বংস” হয়েছে বলা যায় না। এটি “বড় ধরনের ক্ষতি” হয়েছে—এমনটা বলা যায়, কিন্তু “চূড়ান্ত ধ্বংস” নয়।
মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্য বনাম বাস্তবতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সামরিক কর্মকর্তারা প্রায়ই রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে “obliterated”, “destroyed” ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করেন। বাস্তবে, তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন অনেক বেশি সতর্ক—“extremely severe damage”, “significant damage”—এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু “destroyed” শব্দটি তারা সরাসরি ব্যবহার করেন না, কারণ চূড়ান্ত প্রমাণ নেই।

ইরানের প্রতিরক্ষা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
————————————-
ইরান হামলার আগে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রবেশপথ ধ্বংস হলেও, পর্যাপ্ত সময় ও প্রযুক্তি থাকলে ইরান ভবিষ্যতে স্থাপনাটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। অর্থাৎ, ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনাটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে—এটা তাদের জন্য আংশিক বিজয়। তবে, বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে, যা পারমাণবিক কর্মসূচিকে কয়েক বছর পিছিয়ে দিতে পারে।

চূড়ান্ত মূল্যায়ন
————————
“প্রমাণ ছাড়া সম্পূর্ণ ধ্বংস” দাবি করা সঠিক নয়। স্যাটেলাইট চিত্র কেবল বাইরের ক্ষতির প্রমাণ দেয়, ভেতরের ধ্বংসের নয়। তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কোনো প্রমাণ নেই—এটা ইঙ্গিত দেয়, বিস্ফোরণ মূল মজুদের অংশে পৌঁছায়নি বা ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই, মার্কিন হামলা “সম্পূর্ণ সফল” নয়, আবার “সম্পূর্ণ ব্যর্থ”ও নয়; বরং, এটি “আংশিক সফলতা” ও “আংশিক ব্যর্থতা”—উভয় পক্ষের জন্যই কৌশলগত ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

২০২ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন