নতুন পরাশক্তি ইরান: মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী পালাবদল

মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫ ৮:৩৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক সংঘাত ও উত্তেজনার আবহে একটি বিষয় এখন স্পষ্ট—ইরান আর শুধু আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন এক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ এবং যুদ্ধবিরতির নাটকীয় মোড় সবকিছু মিলিয়ে ইরান তার কৌশল, প্রতিরোধ ও কূটনৈতিক সক্ষমতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
ইসরায়েলের অজেয় ভাবমূর্তির পতন
——————————————
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে ‘অজেয়’ শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৪৮, ১৯৫৮, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা পরাশক্তির সহায়তায় আরব দেশগুলোকে পরাজিত করে ইসরায়েল এই ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। কিন্তু সর্বশেষ সংঘাতে ইরানের পাল্টা হামলা ও প্রতিরোধে ইসরায়েল প্রথমবারের মতো বড় ধরনের সামরিক ও কৌশলগত চাপে পড়ে গেছে। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, নেতানিয়াহু প্রশাসন স্পষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তেহরানের কাছে বার্তা পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দম্ভের অবসান
———————————-
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইরান তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজের শর্তে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরও দেশটি শুধু টিকে থাকেনি, বরং কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা তাদের ঐতিহাসিক দম্ভের পতনেরই নামান্তর।
পারস্য জাতির অদম্যতা ও খামেনির নেতৃত্ব
————————————
ইরান বারবার দেখিয়েছে, পারস্য জাতি মাথানত করে না। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ও অবরোধের মধ্যেও ইরান সামরিক, প্রযুক্তি এবং কূটনৈতিক শক্তিতে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান শুধু অভ্যন্তরীণ সংহতি বজায় রাখেনি, বরং আঞ্চলিক মিত্র ও প্রক্সি শক্তি—হিজবুল্লাহ, হুতি, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া গোষ্ঠী—এর মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
পারমাণবিক সক্ষমতা: ধ্বংসের স্বপ্ন অপূর্ণ
—————————————
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ইরান কৌশলে পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে নেয়, ফলে স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি এবং দেশটির হাতে এখনও বিপুল পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা অক্ষুন্ন
———————————
বিগত কয়েক দশকে বহুবার পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েল ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ সামরিক অভিযানেও নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এই হামলা ইরানে সরকার পরিবর্তনের পথ খুলে দেবে। এমনকি সর্ব্বচ্চ নেতা খামেনিকে হত্যার ছক কষেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ইরানের শাসনব্যবস্থা অক্ষুন্ন রয়েছে, বরং আভ্যন্তরীণভাবে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
ইসরায়েলের দুর্বলতা ও নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ
———————————
ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়েছে। এই যুদ্ধ ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এনেছে এবং তাদের ‘পরাশক্তি’ ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ ও পারমাণবিক কর্মসূচির যৌক্তিকতা
ইরান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ ও পারমাণবিক কর্মসূচির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্যের বিপরীতে ইরান যুক্তি দিয়েছে, আঞ্চলিক ভারসাম্য ও আত্মরক্ষার জন্য তাদের কর্মসূচি প্রয়োজন। ইতিহাস বলছে, নতুন পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের আবির্ভাব শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিই পেয়ে থাকে।
নতুন পরাশক্তি: ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান
————————————-
সবশেষে, সাম্প্রতিক সংঘাত, সামরিক প্রতিরোধ, কূটনৈতিক কৌশল এবং অভ্যন্তরীণ সংহতির মাধ্যমে ইরান নতুন এক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একক আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে ইরান এখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। পারস্য জাতি আবারও প্রমাণ করেছে, তারা মাথানত করে না—বরং ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে জানে।
“ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ বিপ্লবটি কেবল ইরানের ইতিহাসের নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়।”
শেষ কথা
——————-
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সাম্প্রতিক অধ্যায় বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরান শুধু আঞ্চলিক শক্তি নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন পরাশক্তি—যার নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দম্ভ, সামরিক আধিপত্য এবং কৌশলগত পরিকল্পনা ইরানের দৃঢ়তা ও কৌশলের সামনে ভেঙে পড়েছে। এই নতুন বাস্তবতা আগামী দিনের মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে।
লেখক: সাংবাদিক,কলামিস্ট
১৬২ বার পড়া হয়েছে