সুর ও আত্মার সাধনা: সঙ্গীত ও ধর্মীয় আরাধনার অন্তর্গত আর্তি

সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫ ২:৩৭ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
কাহলুল জিবরানের একটি কথা দিয়েই আজকের লেখার সূচনা করি - Music is the language of the spirit. It opens the secret of life bringing peace, abolishing strife."
মানুষের হৃদয়ে যে প্রথম ভাষা জন্ম নিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে সুরের ভাষা। শব্দের আগেও মানুষ আত্মা ও অনুভবের সঙ্গে সুরে মিশে কথা বলেছে। ইসলাম, যে ধর্ম শুধু শরিয়তের কাঠামো নয় বরং এক মহাসমন্বিত আধ্যাত্মিক ও মানবিক জীবনদর্শন, সেই ইসলামেও সুর ও ধ্বনির এক অলৌকিক তাৎপর্য ও সাধনা বিদ্যমান। এ সাধনা কেবল কণ্ঠস্বরের নয়, বরং আত্মার — এক অনিঃশেষ উপলব্ধির নাম, যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রভুর নিকটবর্তী হয়। আল্লাহর কালাম, কোরআন, স্বয়ং এক পরম সুরময়, মিরাকলধর্মী পাঠ্যগ্রন্থ, যা ধ্বনি ও ছন্দে আত্মা আলোড়িত করে।
প্লেটো বলেছেন - Music gives a soul to the universe, wings to the mind, flight to the imagination, and life to everything."
এই কলামে আমরা ইসলামের সুরতত্ত্ব, তার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, ইতিহাস ও ভাবের গভীরতা নিয়ে আলোচনা করব।
কোরআনের তিলাওয়াত: সুরের অলৌকিক সৌন্দর্য-ইসলামের সর্বপ্রথম সুরতত্ত্বের প্রকাশ ঘটে কোরআনুল কারিমের তিলাওয়াতের মাধ্যমে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন গুহা হিরাতে ওহি লাভ করেন, তখন প্রথম যে শব্দ তিনি শোনেন তা সুরের স্পন্দনেই ছিল: "إقرأ" (পড়ো)। কোরআনের প্রতিটি আয়াতে এক অন্তর্নিহিত ছন্দ, রিদম ও সুর আছে। কুরআনের আয়াতগুলো যেমন মাক্কী ও মাদানী ভাগে বিভক্ত, তেমনি তাদের ধ্বনি, ধ্রুবতা ও আবেগও ভিন্ন ভিন্ন। একটি আয়াত পড়লে যেমন অন্তর কেঁদে ওঠে, অন্য আয়াতে উত্তাল হয়ে ওঠে চেতনা। হাদীসে এসেছে:
زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ
“তোমাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে কোরআনকে সুন্দর করে তোলো।”— (সহীহ আবু দাউদ, হাদীস ১৪৬৮)
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, ইসলাম কেবল অর্থ বুঝে পাঠকেই নয়, বরং সুর, আবেগ ও হৃদয়নিবেদিত কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেও কোরআনকে উপলব্ধির আহ্বান জানায়।
আজান: হৃদয় জাগানিয়া সুরের মহাকাব্য-পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলা ধ্বনি সম্ভবত আজানের সুর। হযরত বিলাল (রা.)-এর কণ্ঠে উচ্চারিত “আল্লাহু আকবার” সারা মদিনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আজান শুধু নামাযের আহ্বান নয়, বরং তা এক আধ্যাত্মিক জাগরণ, এক অন্তর্লীন স্মরণ। আজানের সুর এক শুদ্ধিকরণ, যা মানুষের আত্মাকে কলুষতা থেকে মুক্ত করে। আজানের সুর সর্বত্র একই থাকলেও, অঞ্চলভেদে এর রাগ, তাল ও ধ্বনি বিন্যাসে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে আজানের সুর বেশ ধীরলয় ও গম্ভীর, আর উপমহাদেশে খানিকটা করুণ রাগে পরিবেশিত হয়। তবে সর্বত্র একটিই লক্ষ্য: অন্তর জাগানো।
ইসলামী সংগীত ও নাশিদ: হৃদয়ের দোয়ার শব্দ-ইসলামে সংগীত নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও, হৃদয় থেকে উৎসারিত পবিত্র সুর — আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমে নিবেদিত নাশিদ, হামদ, না'ত বা কাওয়ালির মতো ইসলামী সংগীতের ধারা কখনও স্তব্ধ হয়নি।
হামদ ও না‘ত- হামদ মানে আল্লাহর প্রশংসা। ইসলামী ইতিহাসে অসংখ্য হামদ-না'ত রচিত হয়েছে যেগুলো আজও মানুষের আত্মাকে আলোড়িত করে। বিশেষ করে উপমহাদেশে হযরত আমীর খসরু (রহঃ)-এর অবদান অতুলনীয়। তাঁর রচিত কাওয়ালি “মন কুঞ্চন লাগি তোসে পিয়া” কিংবা “ছাপ তিলক সব ছিন লি মোসে নাইনা মিলাইকে” — এগুলো কেবল সংগীত নয়, বরং এক ধ্যানে নিমগ্ন আত্মার আকুতি।
নাশিদ ও সমসাময়িক ধারা- আধুনিক সময়ে ইসলামিক নাশিদ বিশ্বজুড়ে এক উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। আরবি, উর্দু, ইংরেজি এমনকি বাংলা ভাষায় অসংখ্য নাশিদ যেমন মাহের জাইন, মিশারি আল আফাসি, সামি ইউসুফ প্রমুখ পরিবেশন করছেন, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে ইসলামের দাওয়াতকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলছে।
সুফিবাদ ও সুর: হৃদয় থেকে হৃদয়ে- সুফিবাদে সুরের সাধনা হলো হৃদয়ের সাধনা। সুফিরা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর প্রতি প্রেম ও উপলব্ধির সবচেয়ে বিশুদ্ধ মাধ্যম হলো সুর।
হজরত আলী (রা:) বলেন: আল-মউসিকি ইউবাহ্জু রুহ"
“সঙ্গীত আত্মাকে আনন্দিত করে।” সামা ও কাওয়ালি: সুফি সাধনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘সামা’ বা শ্রবণ সাধনা। এটি হলো এমন এক সংগীতানুষ্ঠান, যেখানে আধ্যাত্মিক গান ও কাওয়ালির মাধ্যমে আত্মা আল্লাহর দিকে উত্তরণের চেষ্টা করে। কাওয়ালি একদিকে যেমন সুরের আরাধনা, অন্যদিকে এটি আল্লাহর প্রেমে ধ্যানমগ্নতার প্রকাশ। বিশ্ববিখ্যাত সুফি সাধক ও কাওয়াল — নুসরাত ফতেহ আলী খান, সাবরী ব্রাদার্স, এবং বাংলার বাউল শাহ আব্দুল করিম, লালন ফকির-এর গানগুলোর ভেতরেও সেই একই “রূহানিয়্যাত” বা আত্মিক সুর আছে, যা দেহতত্ত্বে আল্লাহর সন্ধান করে।
ইসলামী দর্শনে সুরের তাৎপর্য-
ইসলামে সুর কেবল বিনোদন নয়, বরং এক আত্মিক উপলব্ধি ও ইবাদতের অংশ। কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, আজান, হামদ-না’ত — সবকিছুর ভিতরে সুরের তাৎপর্য সুস্পষ্ট।
হাদীস শরীফে এসেছে:
আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন — (সহীহ মুসলিম)
সুরও সেই সৌন্দর্যের প্রকাশ। তবে ইসলাম স্পষ্টভাবে এমন সংগীতকে নিরুৎসাহিত করে যেটি নাফস বা প্রবৃত্তির পেছনে মানুষকে নিয়ে যায়, আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
বাংলা ভাষায় ইসলামি সুর সাধনা-বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারার গান অনেক পুরনো। ময়মনসিংহ গীতিকা, পালাগান, পুঁথি সাহিত্যে, এমনকি বাউলদের মধ্যেও ইসলামি আধ্যাত্মিকতা, শরীয়তের প্রভাব ও তাসাউফি ভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ—ও মন, মানুষ হইতে চাইলে, মানুষ হতেই হইবে— এ এক দেহতত্ত্বভিত্তিক সুফি আহ্বান।
ইসলামী শরিয়তের মূল উৎস কুরআন ও সহিহ হাদীসে গান বা সংগীত (music) সম্পর্কে সরাসরি অনুমোদনের খুব সীমিত উল্লেখ আছে। তবে কিছু হাদীস আছে যেগুলো ইসলামি সঙ্গীত, কণ্ঠস্বরের সৌন্দর্য, বা উৎসবের সময় গানের অনুমোদনের ইঙ্গিত দেয় — বিশেষত যদি তা অশ্লীলতা, শরাব, নগ্নতা বা গোনাহপূর্ণ পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে। নিচে কিছু ইংরেজি অনুবাদসহ হাদীস উপস্থাপন করছি, যেগুলো গান বা সুরের পক্ষে প্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়:
গান নিয়ে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার থেকে বর্ণিত হাদিসের পরিভাষা এমনটা রয়েছে -
Two young girls were singing in my presence... Abu Bakr came in and said: ‘Musical instruments of Satan in the house of the Messenger of Allah!’ Thereupon, the Prophet ﷺ said: 'Leave them, O Abu Bakr. It is the day of Eid.
— (Sahih al-Bukhari, Hadith 952 and Muslim, Hadith 892)
হাদিসে এভাবেও এসেছে একজন মহিলা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর কাছে এসেছেন এবং গান পরিবেশন করেছেন -
A woman came to the Prophet ﷺ and said: "O Messenger of Allah, I made a vow that if Allah returned you safe, I would beat the duff (drum) and sing before you." He replied, "If you have vowed, then do it."
বাংলার আঞ্চলিক সুরভাষায় গাওয়া হামদ ও না’ত, আজও গ্রামীণ মানুষকে ঈমান ও আত্মজিজ্ঞাসার দিকে টানে।
ইমাম গাযযালী (রহ):
তিনি বলেন, “যে সংগীত হৃদয়ে পবিত্রতা সৃষ্টি করে, প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এবং আল্লাহর স্মরণ জাগায় — তা হারাম নয়, বরং ইবাদতের মতো।”
ইবনু হাযম (আন্দালুসি):
তিনি সংগীতকে বৈধ বলেছেন, যদি তা অশ্লীলতা, মদ্যপান ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হয়।
ইসলামী শরীয়তে যা বৈধ- কোরআনের তিলাওয়াত, আজান,হামদ/না’ত,নাশিদ (যন্ত্রহীন),কাওয়ালি (আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন)
ইসলামী শরীয়তে যা হারাম- অশ্লীল গান,অশ্লীল নাচ বা পরিবেশনা,
মদ্যপান, নারী-পুরুষের ফিতনা-উদ্রেককারী পরিবেশনা।
ইসলামী শিক্ষা ও সুরচর্চার ভবিষ্যৎ- শাহসুফী খাজা ফয়জ উদ্দিন (রহঃ) বলতেন:
"যে হৃদয়ে আল্লাহর যিকির নেই, সে হৃদয় মৃত। আর যে হৃদয় সুরের আর্তনাদে আল্লাহকে ডাকে, সে হৃদয়ই জীবনের প্রকৃত মিনার। সুর যখন আল্লাহর ভালোবাসায় ভিজে, তখন তা হয় আত্মার ভাষা।"
বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো তরুণ প্রজন্মের মাঝে ইসলামি ভাবনার অনুপস্থিতি, যা সুরের আকর্ষণীয় চর্চা দিয়ে সহজেই পূরণ করা সম্ভব। ইসলামি সংগীত যদি আধুনিক মিডিয়ায় যথাযথভাবে তুলে ধরা যায়, তবে তা তরুণদের আত্মিক ও নৈতিক বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন ইসলামি স্কুলে আজ নাশিদ ও হামদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যা এক সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের দিকনির্দেশনা দেয়।
ইসলামে সুর কেবল রস বা বিনোদন নয়, বরং তা এক আত্মিক আহ্বান, আল্লাহর স্মরণ, হৃদয়ের জাগরণ এবং আত্মশুদ্ধির উপায়। সুরের মাধ্যমে কোরআন পড়া, আজান দেওয়া, হামদ-না’ত গাওয়া — এগুলো সবই ইসলামে উৎসাহিত এবং পূণ্যকর্ম। তবে এর শর্ত হলো, এই সুর যেন আল্লাহর দিকে নিয়ে যায়, না যে প্রবৃত্তির দিকে। সুফিদের ভাষায় — সুর এক আলোকরেখা, যে হৃদয়ে পৌঁছালে ইমান জেগে ওঠে।আজকের দিনেও যদি আমরা ইসলামি সুরতত্ত্বের এই অপার সৌন্দর্য আত্মস্থ করি, তবে বিশ্বকে একটি মানবিক ও হৃদয়বান সমাজ উপহার দেওয়া সম্ভব। আমাদের হৃদয়কে সুরময় করে তোলে কোরআনের তিলাওয়াতে, আল্লাহর স্মরণে। কেননা, যে হৃদয় আল্লাহর প্রেমে সুর বাঁধে, তা কখনও শয়তানি কণ্ঠে তাল দেয় না।
লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
১৩০ বার পড়া হয়েছে