সর্বশেষ

আন্তর্জাতিক

ইরান-ইসরাইল সংঘাত ও মার্কিন হামলা: চলমান বাস্তবতার বিশ্লেষণ

মনজুর এহসান চৌধুরী 
মনজুর এহসান চৌধুরী 

রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ ৫:২১ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের জুনে মধ্যপ্রাচ্য নতুন এক সংকটের মুখোমুখি। ইরান-ইসরাইল সংঘাতের দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় নজিরবিহীন বিমান হামলা চালিয়েছে।

এই পদক্ষেপ শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই প্রতিবেদনে মার্কিন হামলার বিবরণ, এর সামরিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য, আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া, এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

মার্কিন হামলার বিবরণ:
২১ জুন শনিবার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায়—ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—একযোগে বিমান হামলা চালিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধি সক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা এবং বিশ্বের জন্য যে পারমাণবিক হুমকি তারা সৃষ্টি করেছে তা বন্ধ করা”।
এই হামলায় মার্কিন B-2 স্টেলথ বোমারু বিমান ব্যবহার করা হয়, যা ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার-বাস্টার বোমা বহনে সক্ষম এবং শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই প্রযুক্তি রয়েছে। ফোর্ডো স্থাপনায় “ফুল পেলোড” বোমা নিক্ষেপ করা হয়, যেটি পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে টমাহক ক্রুজ মিসাইল ব্যবহারের খবরও এসেছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, সব বিমান নিরাপদে ইরানীয় আকাশসীমা ত্যাগ করেছে এবং কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হামলায় ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও অন্তত নয়জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কূটনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিযা:
এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো সরাসরি ইরানের অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালাল, যা সংঘাতের মাত্রা একধাপ বাড়িয়ে দিলো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলাকে “ঐতিহাসিক বিজয়” বলে ঘোষণা দেন এবং বলেন, “এখন শান্তির সময়”। তবে তিনি সতর্ক করেন, ইরান যদি কোনো পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর জবাব দেবে।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা ইতিহাস বদলে দেবে”। হামলার সময় ইসরাইলের নিরাপত্তা ক্যাবিনেট পাঁচ ঘণ্টার ম্যারাথন বৈঠক করে মার্কিন অভিযানের প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করেছে।
ইরান হামলার সত্যতা স্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে, পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ হবে না। ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এই হামলার জবাব আঞ্চলিকভাবে মার্কিন ঘাঁটি ও মিত্রদের ওপর আসতে পারে। ইরান-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন মিলিশিয়া ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীও প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব:
এই হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মার্কিন বাহিনীর ওপর আঞ্চলিক হামলার আশঙ্কা বেড়েছে, বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, বাহরাইন, কাতার, ও কুয়েতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে। ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহ ও তেলের দামে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
রাশিয়া ও চীন এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে, তবে এখনো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ এই সংঘাত দ্রুতই আরও বড় আকার নিতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি:
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করে “যুদ্ধের যৌক্তিকতা” প্রতিষ্ঠা করা। মার্কিন প্রশাসন চাইছে, এই হামলার পর ইরান যদি পাল্টা বড় ধরনের হামলা না করে, তাহলে সংঘাত এখানেই থেমে যেতে পারে। তবে ইরান অতীতে বহুবার বলেছে, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হলে তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি ও জাহাজে আঘাত হানবে—এ সক্ষমতা তাদের রয়েছে এবং ইতিমধ্যে আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
এখন প্রশ্ন, ইরান সরাসরি পাল্টা আক্রমণে যাবে, নাকি কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক চাপ বাড়িয়ে ধাপে ধাপে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক মিত্রদের অবস্থান, এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ভূমিকা—সবকিছুই পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা:
মার্কিন হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসের দাবি যতটা প্রচারিত হচ্ছে, বাস্তবে ততটা নিশ্চিত নয়—কারণ ভূগর্ভস্থ স্থাপনার প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি, তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর মাত্রা, এবং ইরানের বিকল্প প্রস্তুতি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে: তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এখন পুরো অঞ্চল অপেক্ষা করছে—ইরান কীভাবে জবাব দেয়, এবং এই উত্তেজনা আরও বিস্তৃত সংঘাতে রূপ নেয় কিনা। বিশ্ব অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতির জন্য এটি এক অনিশ্চিত ও অস্থির সময়। যুদ্ধ থামবে, নাকি আরও বিস্তৃত হবে—এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ইরান ও তার মিত্রদের পরবর্তী পদক্ষেপের উপর।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৭০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন