১৬ জুন: বাংলাদেশে সাংবাদিকতার কালো দিবস

সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫ ৯:২১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘সাংবাদিকতার কালো দিবস’।
১৯৭৫ সালের এই দিনে দেশের সকল বেসরকারি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা দেশের গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গভীর শোকাবহ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এদিনের স্মরণে দেশের সাংবাদিক সমাজ প্রতিবছর নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালীন সরকার চারটি সরকারি পত্রিকা ছাড়া দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। হাজারো সাংবাদিক, কর্মচারী এবং সংবাদকর্মী রাতারাতি চাকরি হারান, সংবাদপত্র শিল্পে নেমে আসে অন্ধকার। এর ফলে জনগণ সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ থেকে বঞ্চিত হয় এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখনও নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখে। স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার পরিবেশ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে বলে অনেক সাংবাদিক মনে করেন। আইনি চাপ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মামলা ও হুমকির কারণে সাংবাদিকরা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন না। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও হত্যার ঘটনা বেড়েছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, পেশাদারিত্ব ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হাজারেরও বেশি সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, শারীরিক হামলা, হুমকি, হয়রানি ও পেশাগত বাধার সম্মুখীন হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা ১,০০০-এর বেশি বলে বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ আছে।
২০১৪ সালে মোট ২১৩ জন সাংবাদিক ও ৮ জন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হন, যার মধ্যে ৪ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এবং গুরুতর জখম হন ৪০ জন।
২০১৮-২০২৩: শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১,৪৩৬টি মামলা হয়েছে এবং এতে ৪,৫২০ জন অভিযুক্ত, যার মধ্যে অন্তত ৪৫১ জন সাংবাদিক।
২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ১১৯ জন সাংবাদিক নানামুখী হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হন।
২০২৩-২০২৫: বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ১০০-২০০ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই ৮১ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি, মামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর পরিবর্তে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। যেখানে বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন বা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কার্যকর বাস্তবায়ন ও অপপ্রয়োগ রোধে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখা জরুরি। মালিকানার প্রভাব, স্বার্থান্বেষী এজেন্ডা ও স্ব-নিয়ন্ত্রণ (সেলফ সেন্সরশিপ) সাংবাদিকতার মৌলিক চেতনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সাংবাদিকদের সংগঠন ও পেশাদার নেতৃত্বই পারে এই সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখতে।সরকারের কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ থাকলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও নিরাপত্তাহীনতা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও পেশাজীবীরা এ দিনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
১৬ জুন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক শোকাবহ ও প্রতিবাদের দিন। সাংবাদিক সমাজ এই দিনটিকে স্মরণ করে ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৪০ বার পড়া হয়েছে