ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ: হামলা, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিক্রিয়া

শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫ ১১:৩২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৩ জুন ২০২৫, শুক্রবার ভোরে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় নজিরবিহীন বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে পরিচিত এই অভিযানে ইসরায়েল ২০০-র বেশি যুদ্ধবিমান, আধুনিক এফ-৩৫ লাইটনিং ও এফ-১৫ ঈগলসহ বিভিন্ন ধরনের ফাইটার জেট ব্যবহার করে। বহরে গোয়েন্দা নজরদারি ও রিফুয়েলিং বিমানও ছিল। জর্ডান ও ইরাকের আকাশসীমা পেরিয়ে ইসরায়েলি বিমানগুলো ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, যেখানে ব্যবহৃত হয় লংরেঞ্জ মিসাইল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, এই অভিযানে প্রায় ১০০টি লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে হামলা হয়েছে—এর মধ্যে ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, বিপ্লবী গার্ড সদর দপ্তর ও উচ্চপদস্থ সামরিক নেতৃত্বের কার্যালয় অন্তর্ভুক্ত। হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে বাধা দেওয়া এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য তাৎক্ষণিক হুমকি প্রতিহত করা।
ইরানি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই হামলায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (IRGC) কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হোসেইন সালামিসহ কয়েকজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। তেহরান, নাতানজ, ইসফাহান, তাবরিজ, আরাক ও কারমানশাহসহ অন্তত ছয়টি শহরে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। তেহরানে বিপ্লবী গার্ডের সদর দপ্তর এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বড় ধরনের পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেনি।
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ছয়জন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী হলেন। আবদুলহামিদ মিনুচেহর (Abdolhamid Minouchehr), আহমেদরেজা জোলফাগারি (Ahmadreza Zolfaghari), সাইয়্যেদ আমিরহোসেইন ফাকি (Seyyed Amirhossein Feqhi), মোতলাবিজাদেহ (Motalleblizadeh), মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচি (Mohammad Mehdi Tehranchi) ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এবং ফেরেদুন আব্বাসি (Fereydoun Abbasi) ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও সামরিক সক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল এই হামলার পরিকল্পনা করছিল এবং বিভিন্ন মহড়া ও গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে প্রস্তুতি নেয়। গোপন মার্কিন নথি ফাঁস হওয়ার পর জানা যায়, ইরানের সাম্প্রতিক হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই ইসরায়েল এই অভিযান পরিচালনা করেছে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের মহড়াও চালিয়েছিল, যা ছিল এই হামলার প্রস্তুতির অংশ।
ইসরায়েলের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তেহরান থেকে শতাধিক ড্রোন ইসরায়েলের দিকে পাঠানো হয়, যার বেশিরভাগই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিহত করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। ইরান জানিয়েছে, তারা আরও বৃহৎ পরিসরে প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আঞ্চলিক মিত্রদের (যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি) মাধ্যমে প্রক্সি হামলা চালাতে পারে। ইরানের সামরিক মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, ইসরায়েলকে চড়া মূল্য দিতে হবে এবং এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হতে পারে।
ইসরাইলের সাম্প্রতিক ইরান হামলার নিন্দা জানিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলো। তুরস্ক ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জর্ডান ইসরাইলের সামরিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে এবং সরাসরি নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনা স্থগিত করেছে এবং হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, কাতারসহ একাধিক আরব দেশ ইসরাইলের হামলার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে এবং একে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে।
রাশিয়ার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ইরানের ওপর ইসরাইলি হামলায় প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। রাশিয়ার ইন্টারফ্যাক্স সংবাদ সংস্থার বরাতে জানা যায়, রাশিয়া এই হামলাকে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মনে করছে এবং তারা এই সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।
চীন সরাসরি ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানায়নি, তবে ইসরাইল ও ইরানে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে এবং পরিস্থিতিকে “জটিল ও গুরুতর” বলে উল্লেখ করেছে। তারা দুই দেশের নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়াতে ও নিরাপত্তা বাড়াতে বলেছে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে নিন্দা বা সমালোচনামূলক কোনো বিবৃতি দেয়নি।
ইসরায়েল অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। এতে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েল বহুদিন ধরে এই হামলার পরিকল্পনা করছিল এবং তাৎক্ষণিক হুমকির জবাবে অভিযান পরিচালনা করেছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান ড্রোন হামলা শুরু করেছে এবং আরও কঠোর জবাবের হুমকি দিয়েছে, ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে।
সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৬৭ বার পড়া হয়েছে