চন্দ্রদ্বীপে সুফীবাদের শিরোমণি খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ)

মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০২৫ ৭:০২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুগ্রহ ও রহমতে মানবজাতির কল্যাণে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন কিছু মহান আত্মা—দায়ী ইলাল্লাহ, আধ্যাত্মিক সাধক ও মহামনীষী, যাঁদের হৃদয় জুড়ে ছিল খোদাপ্রেম, যাঁদের কর্মজীবন ছিল দাওয়াতি সংগ্রামে পরিপূর্ণ, আর যাঁদের জীবনাচার ছিল তাওহীদ,একামতে দ্বীন ও মারেফাতের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।
তেমনই এক মহান যুগশ্রেষ্ঠ ওলি, যুগদ্রষ্টা, তাপস এবং প্রচারবিমুখ নীরব সাধক ছিলেন আল্লামা শাহ্সুফী হযরত খাজা ফয়জুদ্দীন আল-কাদরী ছাহেব (রহঃ), যাঁর জীবনকাল ১৮৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই মহান আল্লাহর ওলি জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের দক্ষিণাঞ্চলে, আজকের বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্তর্গত ঐতিহাসিক চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের বাখেরগঞ্জ মহাকুমার বুজুর্গ উম্মেদপুর -মরিচবুনিয়া এলাকায়। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম নবাব পরিবারে, যার শেকড় নবাব আহসানউল্লাহর খানদানি বংশে প্রসারিত। হিজরী ১২৭০ (ইংরেজি ১৮৫৪) সালে আল্লাহ প্রদত্ত আলো নিয়ে তিনি ধরণীতে আগমন করেন।
তাঁর পিতা আল্লামা শাহ্সুফী হযরত ছলেমউদ্দীন (রহঃ) ছিলেন একাধারে একজন গভীর দ্বীনী আলেম, সুফী সাধক এবং তৎকালীন সমাজে একজন সম্মানিত বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তাঁর আধ্যাত্মিক পরিবেশ, কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক পরিবার এবং তাওহীদের পূর্ণ অনুশীলনে গঠিত হয়েছিল হযরত খাজা ফয়জুদ্দীনের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অন্তর্জগতের ঔজ্জ্বল্য।
হযরত ফয়জুদ্দীন আল-কাদরী (রহঃ) ছিলেন স্বভাবে শান্ত, স্থিতধী, প্রচারবিমুখ, নির্লোভ, সৎ ও স্বল্পবাক এক মহাপুরুষ। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও নীরব নেতৃত্ব সমাজে আলো ছড়িয়েছিল নিঃশব্দে, কোনো প্রকার প্রচার ব্যতিরেকে। দুনিয়া থেকে বিমুখতা এবং আল্লাহ প্রেমই ছিল তাঁর জীবনের মূল মর্মবাণী। প্রচারের চেয়ে প্রভাব এবং কথার চেয়ে কর্ম ছিল তাঁর দাওয়াতের প্রধান হাতিয়ার।
তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনায় ছিল শরীয়ত ও মারেফাতের গভীর সংমিশ্রণ। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজসংস্কার, অন্তর্জগতের পরিশুদ্ধির মাধ্যমে বাইরের সমাজে আলো ছড়ানো—এই ছিল তাঁর দ্বীনি দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলার ইতিহাসে ইসলাম আগমনের এক উল্লেখযোগ্য ধারাই হচ্ছে সূফীবাদ ও দায়ী ইলাল্লাহদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলামী আদর্শ। ১৩০০ শতাব্দীতে উপমহাদেশে সুফীদের পদার্পণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইসলামের যে ধারা সূচিত হয়, তা ছিল সহনশীলতা, মানবিকতা ও আত্মিক বিকাশের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
বর্ণবৈষম্যের জর্জরিত হিন্দু সমাজে অবহেলিত দলিত শ্রেণি, সমাজচ্যুত বৌদ্ধ ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী ইসলামের সাম্য, ন্যায় ও করুণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। সুফীদের দাওয়াতি মিশন, খানকাহ ও দরবার ছিল তাঁদের আধ্যাত্মিক প্রশান্তির কেন্দ্র। হযরত ফয়জুদ্দীন (রহঃ)-এর মতো ওলিরা তাঁদের হৃদয়গ্রাহী ব্যবহার, সহজ ভাষার উপদেশ ও নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করেছিলেন।
বাংলার মাটিতে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখেন ১৩০০ শতকের দায়ী ও মুফাসসির, ইয়ামেন থেকে আগত শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহঃ)। তিনি সোনারগাঁয়ের মোগরা পাড়ায় উপমহাদেশের প্রথম দরসে বুখারীর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন—যেখানে হাদীস শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো হতো।
এই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিল মক্তব, খানকাহ, মেহমানখানা ও ফোরকানিয়া মাদরাসা। ইসলামী শিক্ষার এই পূণ্যময় পথ ধরে হযরত ফয়জুদ্দীন (রহঃ) তাঁর এলাকাতেও দ্বীন শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে পলাশীর প্রান্তরে মুসলিম শাসনের পতনের পর দীর্ঘ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশ ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। এই সময়ে মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষা, বিজ্ঞান ও দাওয়াতি আন্দোলনে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। এই দুঃসময়ে যারা নবাব উপাধি লাভ করেন, তাঁদের অনেকেই ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন।
ঢাকার কাশ্মিরি খাজা পরিবার এবং ইরাকের বাগদাদ থেকে যাঁদের পূর্বসূরি ছিলেন নায়েব-নাজিমরা, পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘নবাব’ উপাধি পান এবং সে উপাধির সাথে দ্বীনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে ঢাকা, বরিশাল, বাকেরগঞ্জ, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইলসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করেন। হযরত খাজা ফয়জুদ্দীন আল-কাদরী (রহঃ) এই নবাবি ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে সমাজে আলোর দিশা ছড়িয়েছেন নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে।
হযরত ফয়জুদ্দীনের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব শুধু তাঁর খানকাহ বা তাছাউফ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তিনি মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলেছেন, বিশেষত দরিদ্র, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর নেতৃত্বে অনেক মানুষ ইসলামকে তাদের আত্মিক মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করেন।
হযরত খাজা ফয়জুদ্দীন আল-কাদরী (রহঃ)–এর ইন্তেকালের পর তাঁর রেখে যাওয়া আধ্যাত্মিক ধারা, দ্বীনি কর্মধারা ও মানবসেবার মহৎ আদর্শকে জীবন্ত করে রাখেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ্সুফী খাজা নাছের আলী (রহঃ)। তিনি পিতার ন্যায় তাওহীদভিত্তিক আহ্বান, ইসলামী শিক্ষা বিস্তার, সমাজ সংস্কার ও মানবিক সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় মানুষের হৃদয়ে আল্লাহপ্রেম ও দ্বীনের আলো পৌঁছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করেন।
তাঁর জীবনের মূল চালিকাশক্তি ছিল ইখলাস, তাকওয়া এবং আল্লাহর জন্য আত্মনিবেদন। তিনি নিজ গুণে, আল্লাহর সাহায্যে ও পিতৃস্মৃতি বিজড়িত দাওয়াতি আদর্শে দেশব্যাপী সুন্নতের দাওয়াত ছড়িয়ে দেন। তাঁর শিক্ষা, তাজকিয়া ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যায় বহু মানুষ হেদায়াতের আলোয় আলোকিত হয়।
বর্তমান সময়েও খাজা নাছের আলী (রহঃ)-এর যোগ্য উত্তরসূরিরা এই পবিত্র সিলসিলার ধারাকে বহমান রেখেছেন। তাঁরা যথাযথভাবে খানকাহভিত্তিক দাওয়াত, ইলমে মারেফাত, ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবসেবাকে জীবনের মূলধারা হিসেবে ধারণ করে এই পবিত্র তরিকাকে জারি রেখেছেন।
আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, মহান আল্লাহর অপার করুণা ও ইচ্ছায় এই পবিত্র সিলসিলা, এই নূরানী ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেন—
"وَيُرِيدُ اللَّهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ"
"আল্লাহ চান তাঁর কালিমার মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।" (সূরা আনফাল: ৭)
খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) প্রচার বিমুখ ছিলেন, তবে তাঁর নিঃশব্দ কর্মপ্রবাহ ও মজবুত নৈতিক চরিত্র ছিল এমন আকর্ষণীয় যে, দলে দলে মানুষ তাঁর সাহচর্যে ধন্য হতে চাইত। তাঁর জিকির, তাহাজ্জুদ, ইবাদত-বন্দেগি, এবং আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম সমাজে সুন্নতের উপর প্রতিষ্ঠিত এক আধ্যাত্মিক আদর্শ তৈরি করে দেয়।
১৯৫৫ সালে তাঁর ইন্তেকাল ঘটে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আধ্যাত্মিক আলো আজও অনেকের হৃদয়ে ধারণ করেন। তাঁর দাওয়াতি চেতনা, ইসলামী আদর্শে গড়া নেতৃত্ব ও আধ্যাত্মিক সাহসিকতা বাংলার ইসলামী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর উত্তরসূরিরা খানকাহভিত্তিক দাওয়াতি কাজ, কুরআন-হাদীস শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সেবা ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রচারে সচেষ্ট রয়েছেন। তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলো আজও আপামর ধর্মপ্রাণ হৃদয়ে গাঁথা।
আল্লামা শাহ্সুফী হযরত খাজা ফয়জুদ্দীন আল-কাদরী (রহঃ) ছিলেন বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল তারা, যাঁর জীবন ছিল কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক দীপ্ত পথচলা। তাঁর নির্লোভতা, নৈতিকতা, প্রজ্ঞা ও তাওহীদের দাওয়াত আজকের যুগেও আমাদের জন্য এক অনুপম আদর্শ। সুফীবাদের প্রকৃত শিক্ষা হলো আত্মশুদ্ধি, মানুষের সেবা এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মোৎসর্গ। এই সত্য তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাঁর জীবন থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু—বিশেষত এই ভোগবাদী ও আত্মমগ্ন সমাজে হৃদয়বান ও দীনদার মানুষের খুবই প্রয়োজন।
১৩৯ বার পড়া হয়েছে