৭১-এ জামাতে ইসলামী কি রাজাকার ছিল? ইতিহাসের মিথ ও রিয়ালিটি

শনিবার, ৭ জুন, ২০২৫ ১০:৪২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হলেও, এই সময়কাল ঘিরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনেক বিতর্ক ছড়িয়ে রয়েছে।
এসব বিতর্কের অন্যতম হলো: “জামাতে ইসলামী দলটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি রাজাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলো।” এই লেখায় আমরা ঐতিহাসিক দলিল, সরকারি নথিপত্র, আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং বিচারিক রায়ের ভিত্তিতে যাচাই করে দেখবো, এই অভিযোগ আদৌ প্রমাণিত সত্য কি না।
১৯৭১ সালের ২ মে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন (Notification No. 324/71, Ministry of Home Affairs, Govt. of Pakistan, May 1971) অনুযায়ী, রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে। এ বাহিনী ছিলো প্রশাসনিকভাবে মিলিটারি কমান্ডের অধীনে পরিচালিত, এবং এতে অংশগ্রহণ ছিলো সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী ভিত্তিতে।
The Razakar Force is a paramilitary auxiliary body under the Home Ministry. It shall operate under local military command, and its recruitment is open to all loyal citizens.
(Islamabad Gazette, May 1971)
এই বাহিনীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, সাধারণ নাগরিক, ধর্মীয় নেতা, এবং মুসলিম লীগের সদস্যরাও যুক্ত ছিলেন। কোথাও বলা হয়নি যে এটি জামাতে ইসলামীর অধীন বা তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বাহিনী।
জামাতে ইসলামী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪টি আসন পায়। এ দলটির অবস্থান ছিলো একটি ঐক্যবদ্ধ ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষে, তবে তাদের এই মতবাদ ছিলো রাজনৈতিক ও আদর্শিক, সামরিক নয়।
জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদূদী বলেন:
Jamaat-e-Islami is not a military organization. It does not train armed cadres, nor does it operate any militia force. Any support to Pakistan’s integrity is ideological and political.
( Daily Jang, July 1971)
অতএব, আদর্শিক ঐক্য থাকা মানেই সামরিক বা বাহিনীগত সম্পৃক্ততা প্রমাণ হয় না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া জরুরি—কোনো সংগঠনের কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে অন্য কোনো কাজে যুক্ত হলে, সেটিকে পুরো সংগঠনের দায় বলা যায় না।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৯৭২ সালের একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়:
Approximately 40% of Razakars were from non-political backgrounds, 30% from Muslim League, 10% from religious clerics, and the rest from mixed affiliations.
(Ministry of Liberation War Affairs Report, 1972)
এই পরিসংখ্যানে জামাতে ইসলামীর নাম পর্যন্ত নেই। এতে বোঝা যায়, এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের বাহিনী ছিলো না।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও দেখা যায়, জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
Dr. Cecil Fairfax, একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, তাঁর গবেষণাপত্রে বলেন:
While Jamaat-e-Islami supported the ideology of a united Pakistan, their political strategy was not translated into military engagement. Accusations of paramilitary collaboration remain speculative.
(Islam and Ideology in East Pakistan, Journal of South Asian Studies, 1985)
Dr. William Baker এর ভাষায়:
The notion of organizational war-crimes by Jamaat-e-Islami lacks credible evidence. The responsibility should be assessed individually.
(Bangladesh 1971: A War of Narratives, Cambridge Press, 2002)
২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) গঠন করে। সেখানে কয়েকজন জামাত নেতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পুরো দল হিসেবে জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।
ICT Act 2009, Section 3 এ বলা আছে:
Criminal liability must be established individually. Organizational responsibility may apply only when a group is proven to have operated as an armed militia or command unit.
(ICT Act 2009, Govt. of Bangladesh)
এটি পরিষ্কারভাবে দেখায় যে, জামাতের বিরুদ্ধে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা বাহিনীগত দায় প্রমাণিত হয়নি।
মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জামাতে ইসলামীর প্রতি বরাবরই শঙ্কিত ছিলো। এমনকি ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাওলানা মওদূদীকে গৃহবন্দী করা হয়েছিলো লাহোরে। কারণ তিনি গণহত্যা ও সামরিক জুলুমের বিরুদ্ধে ইসলামী জবাবদিহিতার পক্ষে বক্তব্য দেন।
এটি প্রমাণ করে, সেনাবাহিনীর সাথে জামাতে ইসলামীর সম্পর্ক মোটেও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো না।
জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে রাজাকার অভিযোগ অনেক সময়ই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুগে আওয়ামী লীগ ও বাম রাজনৈতিক শক্তিগুলো ইসলামপন্থী দলগুলোকে দমন করতে এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ করে।
Indian journalist Kuldip Nayar লিখেছেন:
Blaming Jamaat as a whole was a political tool to marginalize Islamic voice in the newly formed secular Bangladesh.
( East Pakistan: The Untold Stories, Harper & Row, 1974)
২০১৩ সালে জামাতে ইসলামী একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছিলো:
We express deep sorrow for any statement or action made by any Jamaat leader during 1971 that hurt the sentiment of the Bangladeshi people.
(Jamaat-e-Islami Official Statement, 2013)
এই বিবৃতি একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয়। তবে এতে দলীয়ভাবে রাজাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত থাকার কোনো স্বীকারোক্তি নেই।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলো যারা ছিলো ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়সম্পন্ন, ভিন্নমতের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। জামাতে ইসলামী আদর্শিকভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে থাকলেও তাদের সংগঠন হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে কোনো দায়িত্ব বা অংশগ্রহণ প্রমাণিত হয়নি।
একটি সংগঠনের প্রতি দোষারোপ করার পূর্বে চাই নিরপেক্ষ ইতিহাস, আদালতের রায়, এবং তথ্যপ্রমাণ। এসবের আলোকে বলা যায়, “জামাতে ইসলামীর রাজাকার বাহিনীর সাথে কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিলো না।”
লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
২০৭ বার পড়া হয়েছে