সর্বশেষ

মতামত

বাংলাদেশ-চীন টেকসই অর্থনৈতিক বন্ধুত্বের নয়াদিগন্ত ও ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের দূরদর্শিতা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

বৃহস্পতিবার , ৫ জুন, ২০২৫ ৬:২২ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এক নতুন আশাবাদের সঞ্চার ঘটিয়েছে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও-এর সদ্যসমাপ্ত ঢাকা সফর। ২০২৫ সালের ১ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলন ছিল দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস-এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে চীনা প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে কৃষি, পাট, সামুদ্রিক অর্থনীতি ও গবেষণার ওপর জোর দিয়ে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ভোক্তা সম্ভাবনার একটি তাৎপর্যপূর্ণ চিত্র। তিনি উল্লেখ করেন, রাত ১০টার পরেও বিপণিবিতানে ক্রেতাদের ভিড় দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে। এই তথ্য আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা Euromonitor-এর পূর্বাভাসের সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে বলা হয়েছে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম দ্রুত ক্রমবর্ধমান বাজার। প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ অর্থনীতিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “প্রত্যেকটি গ্রাম একটি উৎপাদন ইউনিটে পরিণত হতে পারে – চীনের স্পর্শে।”

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েনতাও বলেন, “কৃষিকে আমরা শুধু শিল্প নয়, একটি সামাজিক সংগঠনের রূপ হিসেবে দেখি।” চীন যে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: ফার্মল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (চাষযোগ্য জমি উন্নয়ন), ওয়াটার কনজারভেশন (জল সংরক্ষণ কৌশল), প্লান্টিং টেকনোলজি (উন্নত চাষ প্রযুক্তি), এই খাতে চীনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূপ্রকৃতি এবং বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক গভীর সমুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহারে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু চীন ইতোমধ্যেই গভীর সমুদ্র মৎস্য আহরণে বিশ্বের নেতৃত্বে রয়েছে। ওয়েনতাও বলেন, “চীনের রয়েছে সর্বাধুনিক গভীর সমুদ্র ফিশিং টেকনোলজি। আমরা চাই বাংলাদেশ আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে এই খাতে কাজ করুক।” বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীভিত্তিক মৎস্য খাতে চীনের প্রযুক্তি, জাহাজ ও দক্ষ জনবল বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাট শিল্প গত তিন দশকে তার জৌলুশ হারালেও, নতুন করে এই খাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। বর্তমানে চীন বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারের পাট আমদানি করে, যা বাংলাদেশের মোট পাট রপ্তানির ১০ শতাংশের সমান। চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে আমাদের পাট ব্যবসায়ীরা সম্মেলনের মধ্যেই গবেষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়িক সম্পর্কের পাশাপাশি গবেষণায়ও আমাদের একত্রে কাজ করা উচিত।” প্রস্তাব করা হয়েছে বাংলাদেশি ডিজাইনার এবং চীনা প্রযুক্তিবিদদের একত্রে কাজ করার জন্য।

এখানে উল্লেখযোগ্য, একসময়ে পাট ছিল বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত, যা বর্তমানে পোশাক শিল্প দ্বারা স্থানচ্যুত হলেও পরিবেশবান্ধব উপকরণ হিসেবে পাটের চাহিদা আবার বাড়ছে বিশ্ববাজারে। চীন এই পুনরুজ্জীবনের অন্যতম শরিক হতে পারে। প্রফেসর ইউনূস চীনা মন্ত্রীর আগমনে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “আপনার ভাষণ আমার কানে সংগীতের মতো শোনায়। গোটা জাতি আজ আপনাদের আগমন দেখছে।” তিনি আরও বলেন, “আপনারা যেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এটা একটি শক্তিশালী সংকেত।”

এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি ‘বিনিয়োগ-কেন্দ্রিক কূটনীতির’ নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। উল্লেখ্য, প্রফেসর ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরেও বাণিজ্যিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১% বেশি।
বাংলাদেশ চীন থেকে ১৭.৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মূলত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, এবং প্রস্তুত পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ।

একই সময়ে বাংলাদেশ চীনে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পাট, চামড়া, এবং তৈরি পোশাক।

২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, চীনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) বাংলাদেশে পৌঁছেছে ৩.২ বিলিয়ন ডলারে, যা চীনকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা ৫.৫ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
চীনের BRI প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে ৪০ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এবং মহেশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে চীন বাংলাদেশের ৯৮% পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করছে, যা ২০২৬ সালের পরও একটি রূপান্তরকালীন সময়ে বজায় থাকবে। বাংলাদেশ ও চীন একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে, যা ২০২৬ সালের মধ্যে চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ৭টি রেলওয়ে, ১২টি সড়ক, ২১টি সেতু, এবং ৩১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

চীনের উন্নত প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা কেবল পরিসংখ্যানগত অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি নয়, বরং একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাসের অংশ। কৃষি, পাট, মৎস্য ও গবেষণার মতো খাতে যৌথ বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে। শুধু পণ্য নয়, জ্ঞান, কৌশল ও উদ্ভাবনের আদান-প্রদান এই সম্পর্ককে পরিণত করতে পারে একটি টেকসই অর্থনৈতিক বন্ধুত্বে।

চীন বাংলাদেশের পাট রপ্তানিতেও $100 মিলিয়ন (বাংলাদেশের মোট পাট রপ্তানির ১০%) এগিয়ে রয়েছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে হবে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার,বাংলাদেশে বর্তমানে চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ: $১.৩ বিলিয়ন (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪), গভীর সমুদ্র মৎস্য আহরণে চীনের বিশ্ব নেতৃত্ব: Global Fishing Watch

চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও, চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুল্কমুক্ত সুবিধা ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখনই একটি চীন-বাংলাদেশ কৃষি ও মৎস্য সহযোগিতা নীতিমালা প্রণয়ন করা, যেখানে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, এবং যৌথ গবেষণা কেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হবে।

লেখক: বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

১১৯ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন