স্বাধীনতার ৫৪ বছরের বাজেট: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রার চিত্র

মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫ ৮:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দলিল নয়, বরং জাতির অগ্রগতির ধারাবাহিক দলিল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন বাজেট থেকে শুরু করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৫৪তম বাজেট পর্যন্ত, প্রতিটি বাজেটই দেশের অর্থনীতি, রাজস্ব আয়, ঘাটতি এবং বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থাপনা—সবকিছুরই প্রতিচ্ছবি।
যুদ্ধ ও পুনর্গঠনের দশক (১৯৭১-১৯৮০)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার মাত্র ৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করে, যার রাজস্ব আয় ছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ঘাটতি ছিল ৮৮ লাখ টাকা। স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে তাজউদ্দীন আহমদ অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, এরপর ১৯৭৩-৭৪ সালে ৯৯৫ কোটি টাকা এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে ১,০৮৪ কোটি টাকা। এই সময়ে বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক অনুদান ও সহজ শর্তের ঋণের ওপর নির্ভর করা হতো।
আশি-নব্বই দশক: অবকাঠামো ও শিল্পায়নের অগ্রাধিকার
১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ পর্যন্ত বাজেটের আকার দ্রুত বাড়ে। ১৯৮০-৮১ সালে বাজেট দাঁড়ায় ৪,১০৮ কোটি টাকা, ১৯৮৯-৯০ সালে ১২,৭০৩ কোটি টাকা। এই সময়ে অবকাঠামো, কৃষি ও শিল্পায়নে বাজেটের অগ্রাধিকার ছিল স্পষ্ট। বাজেট ঘাটতি নিয়মিতভাবেই বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পূরণ করা হতো। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ১২,৯৬০ কোটি টাকা।
নব্বই দশক ও নতুন সহস্রাব্দ: রাজস্ব আহরণ ও ঘাটতি ব্যবস্থাপনা
১৯৯১-৯২ অর্থবছর থেকে বাজেটের আকার ও রাজস্ব আয় দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২০,৯৪৮ কোটি টাকা, রাজস্ব আয় ১৩,৬৩৭ কোটি টাকা, ঘাটতি ৭,৩১১ কোটি টাকা। এই সময়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণ, বিশেষ করে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। যমুনা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাজেট ঘাটতি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
দুই হাজারের দশক: প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য
২০০০-০১ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৩৮,৫২৪ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেট প্রথমবারের মতো এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তখন বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎসের গুরুত্বও বাড়ে। রাজস্ব আয় বাড়াতে কর কাঠামো সংস্কার ও এনবিআর-এর আধুনিকায়ন শুরু হয়।
সাম্প্রতিক বছর: বিশাল বাজেট, ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণের গুরুত্ব
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৪,৬৪,৫৭৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত বাজেটের আকার প্রতি বছরই বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭,৯৭,০০০ কোটি টাকা, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫,৪১,০০০ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২,২৬,০০০ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭,৯০,০০০ কোটি টাকা, যেখানে ঘাটতি থাকছে ২,২৬,০০০ কোটি টাকা।
এই বিশাল ঘাটতির বড় অংশ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে পূরণ করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান, এবং ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে নেওয়া হয়, যা সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধযোগ্য।
বাজেট ঘাটতি মেটানোর কৌশল
প্রথম থেকেই বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান, ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের ওপর নির্ভর করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট ঘাটতির বড় অংশ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পূরণ করা হচ্ছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, সুদ পরিশোধ, এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাজেট বাস্তবায়নে আরও বেশি কৌশলী হতে হচ্ছে।
৫৪টি বাজেটের ধারাবাহিকতা
প্রথম বাজেটের মাত্র ৮ কোটি টাকা থেকে শুরু করে আজকের প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট—এই দীর্ঘ অভিযাত্রায় বাংলাদেশের বাজেট শুধু অর্থনীতির নয়, জাতির স্বপ্ন, সংকট ও সম্ভাবনার দলিল। প্রতিটি বাজেটে রাজস্ব আয়, ঘাটতি ও ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশল বদলেছে সময়ের সঙ্গে, বদলেছে অগ্রাধিকার ও দর্শন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাজেট গল্প তাই কেবল হিসাবের নয়, অগ্রগতির ইতিহাস।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
১২৫ বার পড়া হয়েছে