সর্বশেষ

মতামত

চিকেন নেক: ভারতের সামরিক প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা?

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

রবিবার, ১ জুন, ২০২৫ ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
শিলিগুড়ি করিডোর, যা ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা এবং উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ভারতের সর্বশেষ সামরিক প্রস্তুতি, আধুনিক যুদ্ধবিমান ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন, এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নজিরবিহীন সেনা সক্রিয়তা শুধু ভারতের নিরাপত্তা নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও এক নতুন কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করছে।

 

শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য ‘লাইফলাইন’। এই করিডোরের ওপর নির্ভর করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত এখানে যে ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছে, তা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি।

 

পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমানঘাঁটিতে রাফাল স্কোয়াড্রন মোতায়েন ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ও আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়েছে। রাফাল যুদ্ধবিমান স্বল্প সময়ে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, যা করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার হাসিমারা বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী রাফাল যুদ্ধবিমানের একটি পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড্রন মোতায়েন করেছে। এই ঘাঁটি শিলিগুড়ি করিডোরের খুব কাছেই এবং এখান থেকেই রাফাল যুদ্ধবিমানগুলো দ্রুত আক্রমনে সক্ষম।

 

এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এই অত্যাধুনিক রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত শত্রু বিমান, ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারে। ফলে, চীন বা বাংলাদেশের দিক থেকে যেকোনো আকাশপথের হুমকি দ্রুত প্রতিহত করা সম্ভব। 

শিলিগুড়ি শহরের কাছেই শুকনায় অবস্থিত ত্রিশক্তি কর্পস (Trishakti Corps) বা 33 Corps-এর সদর দপ্তর। এই কর্পসের মূল দায়িত্বই হলো শিলিগুড়ি করিডোর ও আশপাশের কৌশলগত অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শুকনা থেকে সেনা ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্রুত মোতায়েন করা সম্ভব।

 

শিলিগুড়ি শহর ও করিডোরের আশপাশে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন: এস-৪০০, ব্রহ্মোস, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এমআরএসএএম) মোতায়েন করা হয়েছে।

শুকনা, শিলিগুড়ি, হাসিমারা ও আশপাশে স্থলবাহিনী, ট্যাংক, আর্টিলারি, স্পেশাল ফোর্স, প্রকৌশলী ও সিগন্যাল কোরসহ আধুনিক সেনা ইউনিট মোতায়েন রয়েছে।

 

বৃহৎ সামরিক মহড়া, তিস্তা প্রহার’সহ একাধিক পূর্ণাঙ্গ সামরিক মহড়ায় ভারত যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি, দ্রুত সেনা সমাবেশ, যৌথ বাহিনী পরিচালনা ও আকাশ-স্থল সমন্বয়ের অনুশীলন করেছে।

 

করিডোরের ভেতরে ও আশপাশে নতুন রেললাইন, দ্রুত সেনা পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত ব‍্যবস্থা নেয়া যায়।

 

ভারতের এই সামরিক প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য সরাসরি আক্রমণের হুমকি নয়—তবে কৌশলগত, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে তা বেশ উদ্বেগজনক।

 

শিলিগুড়ি করিডোরে সংঘাত বা সামরিক উত্তেজনা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। ভারতের সন্দেহ, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ঘাঁটি (বিশেষত লালমনিরহাট) চীনা সহায়তায় আধুনিকায়িত হলে, তা করিডোরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। ফলে, ভারতীয় বাহিনী সীমান্তে আরও আগ্রাসী ও সতর্ক হতে পারে, যা সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকীকরণ, বিশেষত চীন বা তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি সংগ্রহ, ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সন্দেহের কারণ। ভারত মনে করছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চীন কোনোভাবে ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে।

 

শিলিগুড়ি করিডোরে সংঘাত হলে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শরণার্থী প্রবাহ, সীমান্ত বাণিজ্যে স্থবিরতা, এবং মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে।

 

ভারত যদি বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে—যেমন, সীমান্তে সেনা বাড়ানো, কূটনৈতিক বার্তা, বা বাণিজ্যিক সুবিধা সীমিত করা—তাহলে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বাধীনতা সংকুচিত হতে পারে। একইসঙ্গে, চীন বা অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে ভারত আরও কঠোর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।

 

এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমান্তে আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আকাশ প্রতিরক্ষা ও সীমান্তবর্তী সামরিক ঘাঁটির আধুনিকায়ন জরুরি, যাতে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে দ্রুত ব‍্যবস্থা নেয়া যায়। সীমান্ত অঞ্চলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা প্রস্তুত রাখতে হবে। সীমান্ত অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক, তথ্যনির্ভর ও দায়িত্বশীল থাকতে উৎসাহিত করতে হবে।

শিলিগুড়ি করিডোরে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য সরাসরি আক্রমণের হুমকি না হলেও, ব্যাপক কৌশলগত চাপ ও নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন এক জটিল বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

 

তাই, কৌশলগত ভারসাম্য, আস্থার পরিবেশ, সীমান্ত নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সংলাপ, এবং মানবিক প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোতে হবে।

 

এটাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র পথ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট 

১৮০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন