তবুও বেঁচে থাকতে চাই...

শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫ ৮:১৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
যখনই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই, তখনই মেয়েটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি কোথায় যাচ্ছো বাবা! আমি বলি, বাহিরে --
মেয়েটাও বলে, বাহিরে! মানে! তুমি বাজারে যাচ্ছো? আমার জন্য কিছু কিনতে যাচ্ছো বাবা? হুম --
তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো বাবা? হুম --
আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা! তাড়াতাড়ি চলে এসো বাবা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না বাবা! আমার জন্য চকলেট কিনে নিয়ে এসো বাবা --
বড় মেয়েটা কাছে আসে, তাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, তুই যেখানে থাকিস, এখান থেকে চলে যা। জানিস না, বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে?
আমি বাবার সঙ্গে বাইরে যাচ্ছি, তোকে নেবোই না। তাই না বাবা? হুম --। বাজার আসার কিছুক্ষণ পর পরই ফোন দিতে থাকে। বলে, বাবা তুমি কি করছো বাবা! বাড়িতে চলে এসো বাবা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না বাবা!
ছোট মেয়েটার (মৌ) সঙ্গে প্রতিদিন এরকম হয় আমার।
আমার মতো যাদের ছোট ছেলে বা মেয়ে রয়েছে, তাদেরকেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
আমরা ছোটবেলায় বাবাকে খুব মিস করতাম, কিন্তু এতোটা নয় বা এভাবে নয়। আমি বাবাকে ভালো লাগার কথা কিংবা বাবাকে ভালোবাসি, এ কথাটা কখনো বলতেই পারিনি। বাবাকে ভয় পেতাম খুব, ভালোও বাসতাম খুব। শুধু বলা হয়নি আমার মেয়ের মতো করে। আমি ও পরিবারের সকলেই মেয়েটাকে খুব ভালোবাসি, শুধু ওর মুখের কথার জন্যে।
এখন মনে হয়, আমি যদি বাবাকে বলতে পারতাম, তাহলে বাবাও আমাকে সরাসরি আমার মতোই ভালোবাসতো। বাজারে যাওয়ার সময় আমার কপালে ও গালে হামি দিয়ে যেতো --
মেয়েটার জন্য বারবার মনে পড়ে বাবার কথা। চোখে পানিও চলে আসে। মেয়েটা লক্ষ্য করে বলে, তোমার চোখে পানি কেন বাবা! আমি বলি, এমনিতেই --
মেয়েটা আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা!
বাড়িতে নানা কথার মাঝে যদি বলে ফেলি, মরে গেলেও বেঁচে যেতাম। মেয়েটা দৌড়ে কাছে এসে বলে, তুমি মরবে কেন বাবা! তুমি জানো না, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না বাবা --
১৬ মে, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রূপক মারা গেছে। রূপক আমার জুনিয়র, ছোট ভাইয়ের বন্ধু। কিন্তু আমারও খুব কাছের একজন। ওরা ২০০১-২০০৪ সালের দিকে কুষ্টিয়া বাবর আলী গেটের পাশের একটা মেসে থাকতো। একই মেসে থাকতো সাংবাদিক মাহমুদ শরীফ ও শিপন। তখন শরীফ কুষ্টিয়ার দৈনিক বজ্রপাত, শিপন রাজবাড়ির দৈনিক গতকাল, আর আমি কুষ্টিয়ার দৈনিক আজকের আলো পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলাম।
তখন কুষ্টিয়া রিপোর্ট পাঠানো খুব কষ্টের ছিল। আমরা খোকসার একজন কুরিয়ার সার্ভিসের বাহকের মাধ্যমে রিপোর্ট কুষ্টিয়া পাঠাতাম। তখনো ই-মেইল দুরের কথা, ফ্যাক্সও ছিল না। মাঝে মাঝে আমি যেতাম কুষ্টিয়া। রাতের সাটল ট্রেনে ফিরে আসতাম কুমারখালী। আবার কখনো থেকেও যেতাম কুষ্টিয়া। আমার ছোট ভাই রিজভী দৈনিক আজকের আলোর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিল। কুষ্টিয়াতেই থাকতো। কিন্তু আমি মাহমুদ শরীফ, রূপক ও শিপনদের সঙ্গে ওদের মেসে থাকতাম। রাতে আড্ডা জমতো খুব।
সেই রূপক আজ চলে গেলো! ভারত থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করে এসে ভালোই চলছিল। একসঙ্গে বসে অনেক গল্প শুনিয়েছিলো অপারেশনের। যদিও গল্প শুনেই আমার গা ঘেমে যাচ্ছিল। কিন্তু রূপক হাঁসতে হাঁসতে অপারেশনের গল্প করলো। সঙ্গে ছিলো ওর সহধর্মিণী।
রূপকের ছোট বাচ্চা রয়েছে। আজ রূপক নেই। বাচ্চারা কাল থেকে আর বাবাকে দেখবে না, ডাকলে বাবা শুনবে না, কাছেও টেনে নেবে না, শিল্পকলায় বা স্কুলে নিয়ে যাবে না, পূজার সময় আর ঘুরাতে নিয়ে যাবে না, একসঙ্গে ঘুমাবেও না। কিন্তু বাচ্চাদের তো বাবার কথা বারবার মনে পড়বে, ওরা কিভাবে মেনে নেবে, ওদের বাবা চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে গেছে! আর জাগবে না, আসবেও না কোনোদিন।
রূপকের মতো মৃত্যু আমি চাই না, মেনে নিতে পারছি না, নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে --
আজও মেয়েটাকে নিয়ে পুকুরে গোসল করতে নেমেছিলাম। একটু এদিকওদিক হতে না হতেই মেয়েটা বলছে, বাবা, আমাকে বাঁচাও বাবা!
আমার বাবা আমাকে অনেক বড় রেখে চলে গেছেন, তবুও আমার কেমন কষ্ট হয়, তা কেউ জানে না। আজ রূপক চলে গেলো, একদিন আমি ও চলে যাবো। আমার মেয়েটাও সেদিন কষ্ট পাবে, রূপকের মেয়ের মতোই, আমার বাবার জন্য যেমন আমি কষ্ট পাই। আমার বাবাও তার বাবার জন্য কষ্ট পেতেন।
বাবা তার বাবা-মাকে ছেড়ে আরেক দেশে চলে এসেছিলেন। ইচ্ছে করলেই দেখা সাক্ষাৎ করতে পারতেন না। চিঠি দিলেও উত্তর পেতে এক মাসের অধিক সময় অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু বাবা রাতে ঘুমের মধ্যে উচ্চস্বরে “মা মা” বলে চিৎকার করে উঠতেন। কান্নাকাটি করতেন। মন খারাপ থাকতো তার। তখন তেমন একটা বুঝতাম না। এখন বুঝি, সবাই তাদের বাবাদের জন্য কষ্ট পান।
আমার আম্মাকে দেখেছি, তার বাবা মারা যাওয়ার দিন মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে। এর আগে কখনোই এভাবে কাঁদতে দেখিনি আম্মাকে...
লেখক: সাংবাদিক ও সামাজিক কর্মী।
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
২৩৬ বার পড়া হয়েছে