বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক দমন: সময়কালীন বিশ্লেষণ

মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫ ৭:৫২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের গুম, খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো — বিশেষত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) — "ক্রসফায়ার" বা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বহু মানুষকে হত্যা করেছে।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে পাঁচ শতাধিক গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এসব ঘটনার অধিকাংশেই ভুক্তভোগীরা ছিলেন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক আন্দোলন কিংবা নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত। গুম বা অপহরণের পর অনেকেরই খোঁজ মেলেনি, কেউ কেউ পরে মৃত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন। অনেকক্ষেত্রে পরিবারকেও জানানো হয়নি কেন বা কী অভিযোগে তাদের প্রিয়জনকে আটক করা হয়েছে।
বিশেষ করে জুলাই ও আগস্ট মাসে এই ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা বেড়ে যায়। এই সময়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারে একটি উত্তপ্ত সময় হিসেবে বিবেচিত। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ও কৌশলগত কিছু কারণ। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত তৎপরতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা উসকে ওঠে। অনেক সময় এ সময়েই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে, যার ফলে বিরোধীদল বা সরকারবিরোধী মতাদর্শকে দমন করতেই নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকার নানা অভিযানে নামে।
সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা বাড়লে সরকারপ্রধান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় তা দমন করতে সরাসরি অপারেশন চালায়। এসব অভিযান গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের অধিকার এবং মানবিক মর্যাদার পরিপন্থী। দেশের সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব অধিকারের সুষ্ঠু প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
২০২১ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাব ও এর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটি ছিল বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। এর আগে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এই ধরণের দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি। এই নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর চিন্তার জন্ম দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতা, প্রতিহিংসা এবং বিচারহীনতার যে এক অদৃশ্য চক্র বিদ্যমান, তা প্রতিবছরই জুলাই-আগস্ট মাসে বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে মানবাধিকার পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শুধু নির্বাচন নয়, বরং সেখানে থাকা উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার সুনিশ্চিত কাঠামো।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলন ছিল একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা সহিংস দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (OHCHR) জানায়, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত ১৪০০ জন নিহত হন, যার মধ্যে ১২–১৩ শতাংশ ছিল শিশু। এ সময় প্রায় ১১,৭০০ জনকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়, যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না। হাজার হাজার মানুষ আহত হন।
বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়, অনেক মরদেহ গোপন করা হয় বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আহতদের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি জব্দ করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়। আইনজীবী, সাংবাদিক ও ভুক্তভোগীদের পরিবারকেও ভয়ভীতি ও হুমকির মুখে পড়তে হয়। এসব ঘটনায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়ের চূড়ান্ত পতন ঘটে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
২৬ থেকে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে ছয়জন ছাত্র ও মানবাধিকার কর্মীকে আটক করে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়। তাদের একটি ভিডিও বার্তা সরকার-সমর্থিত প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিত হয়। এই অপমানজনক কর্মকাণ্ড স্বাধীন মতপ্রকাশ ও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী ছিল।
বিক্ষোভকারীদের চাপ এবং সহিংসতার চরমে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। এরপর সেনাবাহিনী, ছাত্রনেতারা ও নাগরিক সমাজের একাংশের সমর্থনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পূর্ণ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্ত দল ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলির উপর একটি স্বাধীন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। তারা প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছে এবং একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করছে যা আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থায় বাংলাদেশের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ধারাবাহিকতা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিপন্ন করছে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, কোনো সমাজেই দমনপীড়ন, ভয়ের সংস্কৃতি এবং প্রতিহিংসার ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। একটি মানবিক, ইনসাফপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ে মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর জবাবদিহি, ন্যায়বিচার এবং সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা লাইট হাউজের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশী সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজ কর্মী।
১৩০ বার পড়া হয়েছে