প্রকৃত স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশ: গণআন্দোলনে নতুন সংবিধানের দাবি

বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫ ৯:৫০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
গত বুধবার (৭ মে ২০২৫) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানবাধিকার সংস্থা ‘লাইট হাউজ’-এর মানববন্ধন ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় গভীর সাড়া ফেলেছে বলেই আমার বিশ্বাস। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—“জুলাই বিপ্লব সনদ চাই”, “ন্যায়ভিত্তিক সংবিধান চাই”।
এগুলো ছিল ২০২৪ সালের ভয়াবহ ‘জুলাই বিপ্লব’-পরবর্তী সামাজিক পুনর্গঠনের এক প্রখর আহ্বান, বিচ্ছিন্ন কোনো ইভেন্ট নয়। জাতীয় গণমাধ্যম দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক নয়াদিগন্ত সহ অনেকগুলো জাতীয় গণমাধ্যম অতি গুরুত্বের সাথে নিউজটি পাবলিশড করেছে জাতীয় ও গণমানুষের স্বার্থে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস - The High Commissioner for Human Rights (OHCHR) এর বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমন পূরণ বিষয়ক তথ্য মতে - Between July 1 and August 5, 2024, at least 1,400 people were killed—12–13% of them children—and some 11,700 were arrested or detained without specific charges. Thousands more were injured.
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ এক দীর্ঘদিনের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও তার বিনিময়ে দিতে হয়েছিল ভয়ংকর মূল্য। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, তিন সপ্তাহের দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সেই রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতা শিক্ষা দিয়েছে—বিদ্রোহ পরিবর্তনের পথ খুলে দিতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার মজবুত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কার্যকর নতুন আইন।
শুধু স্লোগান দিয়ে পরিবর্তন আসেনা—এই উপলব্ধি থেকেই গত এক বছর ধরে নাগরিক সমাজ কাজ করে চলছে পূর্ণাঙ্গ নতুন সংবিধানের জন্য। এর ফলস্বরূপ ১৫ জানুয়ারি ২০২৫-এ সংবিধান সংস্কার কমিশন (CnRC) তার ৬০০ পৃষ্ঠার সুপারিশপত্র জমা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে, যার নেতৃত্ব দেন নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই প্রস্তাবনায় সামাজিক ন্যায়বিচার, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
যদিও এসব সুপারিশ এখনও আইনে রূপায়িত হয়নি, ‘লাইট হাউজ’ এর মতো সংগঠন বলছে—“রাস্তায় গণচাপ না থাকলে এসব প্রস্তাব শুধুই নথি হিসেবে থেকেই যাবে।” মানববন্ধনে বক্তারা ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার’, ‘সমাজের নিচুস্তরের মানুষের অধিকার’ ও সংবিধানের পূর্ণ পুনর্গঠনের দাবি তুলে ধরেন।
লাইট হাউজের সদস্য সচিব, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এ বি এম সাইফুল্লাহ বলেন, “নতুন সংবিধানের মাধ্যমে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা চালু করলেই ‘জুলাই বিপ্লব’ সার্থক হবে।”
লাইট হাউজের আহবায়ক,বিশিষ্ট সাংবাদিক,বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফেরদৌস আহমদ বলেন -লাইট হাউস একটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক নাগরিক সংগঠন, যেটা দেশ ও জাতির জন্য কাজ করবে।কৃষক- শ্রমিক, দিনমজুর ও মজলুম নিপীড়িত মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরব থাকবে।
জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা "লাইট হাউজ" মনে করে—সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মৌলিক অধিকার, খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে; জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি চালু করে বড় দলগুলোর একচেটিয়া দখল ভাঙতে হবে; এবং ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ তদন্তে আঞ্চলিক কমিশন গঠন করতে হবে।
এই প্রস্তাবগুলো যতই সাহসী হোক, অবাস্তব নয়। কারণ মাত্র দুই মাস আগে ছাত্রনেতারা গঠন করেছেন নতুন রাজনৈতিক দল—“ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (NCP)”—যারা তাদের মূল লক্ষ্যে ঘোষণা করেছে “দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র” গঠন।
অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে তো ইতিমধ্যে ১৭ বার সংশোধনী হয়েছে—আরেকবার করলেই হতো। কিন্তু সমস্যা আইনি নয়; তা নৈতিক বৈধতা, অধিকার কাঠামো ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতায় নিহিত।
নৈতিক বৈধতা: ২০২৪ সালের বিপ্লব প্রমাণ করেছে, বর্তমান সংবিধান জনগণের বিশ্বাস হারিয়েছে।
অধিকার কাঠামো: শ্রমিক ও কৃষকের মৌলিক অধিকার এখনও দিকনির্দেশনামূলক নীতিতে সীমাবদ্ধ, বাস্তবায়নে অনুপস্থিত।
ক্ষমতার ভারসাম্য: প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত ক্ষমতা, দুর্বল সংসদ ও বিচারব্যবস্থা একযোগে বর্তমান কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া ঝুঁকিমুক্ত নয়। মিশরে দেখা গেছে, বিদ্রোহ-পরবর্তী সংবিধান যদি জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তৈরি করা হয়, তা তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ে। পাশাপাশি, প্রতিবেশী ভারত ও চীনসহ অভ্যন্তরীণ এলিট শ্রেণিও র্যাডিকাল পরিবর্তন হতে বাধা দেবে।
তবুও এই প্রক্রিয়াকে থামানো যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা ড. ইউনূস ডিসেম্বর ২০২৫-এ নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা করেছেন; ফলে যেকোনো রাজনৈতিক দলকে সংবিধান সংস্কার নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকেও এখন নৈতিক আত্মসমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে।
ব্রুস অ্যাকারম্যানের কথায়—“সংবিধানিক মুহূর্ত” তখনই আসে যখন সাধারণ মানুষ আইনকে নিজের করে নিতে চায়। বাংলাদেশ সম্ভবত সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। ‘লাইট হাউজের’ মানববন্ধন হয়তো রাজধানীর যানবাহন থামায়নি, কিন্তু তা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—সংবিধান আর কাগজে লেখা নয়, মানুষের দাবির কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়; বরং কৃষক, ছাত্র ও শ্রমিকদের মতপ্রকাশের স্বচ্ছ ও মুক্ত পরিসর রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। এই পরিসর তৈরি হয়েছে জুলাইয়ের রক্তঝরা প্রেক্ষাপটে। এখন প্রশ্ন—এই সুযোগ কি আমরা হারাব, না তা কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলব একটি নতুন, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্র?
লেখকঃ খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা লাইট হাউজের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।
১৬৮ বার পড়া হয়েছে