অটোরিকশার জঞ্জাল থেকে মুক্তি কবে?

বৃহস্পতিবার , ৮ মে, ২০২৫ ৮:১৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আজকাল বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সবখানেই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার অবাধ বিচরণ। একদিকে যেমন এটি অনেকের জন্য জীবিকার সহজ উৎস, অন্যদিকে এর অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং সড়ক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজলভ্যতা এবং সহজে আয়ের উৎস হওয়ায় দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে সুবিধাজনক বাহনটি যে আমাদের পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিপদ ডেকে আনছে, সে বিষয়ে আমরা কি যথেষ্ট সচেতন?
অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলকারী অটোরিকশা সড়ক নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশিক্ষণবিহীন চালক, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়াও, অটোরিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেক সময় দুর্বল থাকে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়ায়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলার কারণে অটোরিকশাগুলো অহরহ দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। রাস্তার শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। আমরা শুধু এর "ধোঁয়াবিহীন" দিকটি দেখে পরিবেশবান্ধব বলে মনে করছি। কিন্তু এর যে আরও অনেক ক্ষতিকর দিক আছে, তা আমরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি।
অটোরিকশা একদিকে যেমন অনেকের জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে এটি যানজট সৃষ্টি করে এবং অন্যান্য পরিবহনের জন্য সমস্যা তৈরি করে। এছাড়াও, এর সহজলভ্যতা অনেক তরুণকে পড়াশোনা ছেড়ে এই পেশায় আসতে উৎসাহিত করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
যদিও অটোরিকশা ধোঁয়াবিহীন হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশবান্ধব মনে হতে পারে, এর ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সীসা (Lead) একটি মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ। ব্যবহৃত ব্যাটারি থেকে নির্গত সীসা মাটি ও পানিতে মিশে পরিবেশকে দূষিত করছে। এই দূষণ খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সীসা মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও, ব্যবহৃত ব্যাটারি সঠিকভাবে রিসাইক্লিং না হওয়ায় এটি পরিবেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
যখন এই ব্যাটারিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় বা সঠিকভাবে রিসাইক্লিং করা হয় না, তখন সীসা মাটি, পানি এবং বাতাসে মিশে যায়। এর ফলে মাটি দূষিত হয়, জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয় এবং পরিশেষে তা মানবদেহে প্রবেশ করে। সীসার বিষক্রিয়া মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে এটি চরম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমরা স্বল্পমেয়াদী সুবিধার কথা ভাবছি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা একবারও চিন্তা করছি না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যে দেশগুলো আমাদের কাছে এই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা রপ্তানি করছে, তাদের নিজেদের দেশে কি এগুলো একই পরিমাণে চলাচল করে? আমাদের কাছে কি এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান আছে? সম্ভবত নেই। তারা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক লাভের জন্য আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই প্রযুক্তি চাপিয়ে দিচ্ছে। আমাদের পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অনেক উন্নত দেশে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে এই ধরণের যান চলাচল সীমিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যবসায়িক মুনাফার লোভে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই "আবর্জনা" ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে ফেলছে। এই অটোরিকশাগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারি এবং অন্যান্য আবর্জনা কোথায় যাবে, সে বিষয়েও আমরা ভাবছি না। রপ্তানিকারকরা শুধু ডলার গুনতেই ব্যস্ত। এই আবর্জনাগুলো আমাদের পরিবেশের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
এখনই সময় এই অটোরিকশার জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারের উচিত এই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করা এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া উচিত। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যকে বাঁচাতে হলে এখনই এই বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২৪৭ বার পড়া হয়েছে