উথোয়াইয়ই মারমার উদ্যোগে দুর্গম পাহাড়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা

রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫ ২:৪১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোপা বদলাপাড়া, যেখানে পৌঁছানো সহজ নয়।
লামা থেকে কিছুটা সড়কপথ অতিক্রম করার পর, ঠাকুরঝিরি ও জঙ্গলের মধ্যে প্রায় ২ ঘণ্টার হাঁটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, মোবাইল নেটওয়ার্ক, কিংবা হাসপাতালের মতো সেবা কিছুই নেই। আশপাশের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকায় কোন বিদ্যালয়ও ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর, ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, এই গ্রামে শুরু হয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়—‘পোপা বদলাপাড়া আশা-হোফনূং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
বর্তমানে এখানে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলছে, এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৩৯ জন, শিক্ষক দুজন। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন, যেটির পিছনে রয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা উথোয়াইয়ই মারমা।
শৈশবের সংগ্রাম
উথোয়াইয়ই মারমা লামার গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তিনি এক কঠিন পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েছেন, যেখানে মা-বাবা শিক্ষার সুযোগ পাননি, কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। তার প্রথম স্কুল ছিল বড়বমু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এরপর তিনি লামা সদরে আবু তাহের মিয়া নামে একজনের বাড়িতে চলে আসেন এবং সেখানে পড়াশোনা শুরু করেন।
২০০৯ সালে এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পর, উথোয়াইয়ই উন্মূক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১২ সালে শিক্ষক হিসেবে তিনি থানচির হালিরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন, পরে বদলি হয়ে আসেন চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
দুর্গম পাহাড়ে আলোর মিশন
কোলেজের দিনগুলো থেকেই উথোয়াইয়ইয়ের ছবি তোলা এবং ভিডিও বানানোর প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি দুর্গম পাহাড়ে ছবি তুলতে গিয়ে ফেসবুকে সেই অঞ্চলের জীবনের চিত্র তুলে ধরতেন। এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সমাজসেবা কার্যক্রমে অংশ নেন, যেমন ব্লাড ব্যাংক, মেডিক্যাল ক্যাম্প, শীতবস্ত্র বিতরণ ইত্যাদি। ফেসবুকে "উথোয়াই ভয়েজার" নামে একটি পেজ খুলে দুর্গম অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে অনেক গল্প শেয়ার করেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
২০১৬ সালে গজালিয়ার ম্রো পাড়ায় পাড়াভিত্তিক একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। পরে উথোয়াইয়ই সেই স্কুলটিকে একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে সহায়তার মাধ্যমে তিন কক্ষের একটি টিনশেড ভবন নির্মিত হয়, যার নাম রাখা হয় পাওমুম থারক্লা, যার মানে 'কলি থেকে ফোটা ফুল'। এরপর আশপাশের পাড়াগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করতে আসতে থাকে। তবে স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল, তাই স্কুলের তহবিল সংগ্রহের জন্য ম্রো শিশুদের দিয়ে ছবি আঁকার কর্মশালা আয়োজন করা হয় এবং সেই ছবিগুলো বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
২০২১ সালে উথোয়াইয়ইদের উদ্যোগে একটি দোতলা স্কুল ভবন নির্মিত হয়। শাহরিয়ার পারভেজ জানান, "পাওমুম শুধু একটি স্কুল নয়, এটি একটি সম্প্রদায়ের উন্নয়ন প্রকল্প। আমাদের প্রধান কাজ ছিল প্রাথমিক শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়া, তবে এখানকার অনেক সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, যেমন সুপেয় পানির অভাব।"
নতুন উচ্চতায় শিক্ষার অগ্রযাত্রা
২০২১ সালে, উথোয়াইয়ই মারমা লামার সরই ইউনিয়নে ‘চেননৈ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা আরও একটি শিক্ষার অগ্রযাত্রার মাইলফলক।
১২১ বার পড়া হয়েছে