সন্তান জিতে গেলে জিতে যায় মা বাবা, এমনই এক বাবা মেয়ের গল্প

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ২:৩৭ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
প্রতিটা সন্তানই তার বাবা মায়ের আদর্শে বড় হয়, প্রত্যেকেই চায় বাবার মতো হতে। কিন্তু বাবার থেকেও এক পুরুষ এগিয়ে থাকা সন্তানের মাঝেই পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া দাদার প্রতিচ্ছবি। এমনই এক মহীয়সী আনিকার গল্প থাকছে তার বাবা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিবের ফেসবুকের লেখনীতে।
"আমার কন্যা মৃত্তিকা
নিরন্তর হতাশা ও কষ্টের অলঙ্ঘনীয় অবরুদ্ধতার মাঝে আজকের দিনটা আমার জীবনে ক্ষণেক কিন্তু অনেক সুখের। হৃদয়ের গহীণ কোণও আজ দুলে উঠছে অনাবিল শান্তির সমীরণে।
আমার কন্যা আনিকা প্রিয়দর্শিনী মৃত্তিকা। আমার পরিবার ছোট। ওর একমাত্র ভাই, আর ওর মা। মৃত্তিকা তার ভাইয়ের চেয়ে তিন বছরের বড়। মনে পড়ে, এই সেদিনের কথা। আমি ও আমার স্ত্রী আমেনা বেগম তখন কুষ্টিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট। ২০০৪ সাল। আমি ও ওর মা ওকে কোলে করে নিয়ে যাই, বাসায় পাশেই অবস্থিত কলকাকলি স্কুলে প্লে-গ্রুপে ভর্তি করাব বলে। আমেনা বেগম-এর ব্যাচমেট এ. কে. এম সোহেল এর মা তখন কলকাকলি স্কুলের শিক্ষক। তার কাছে ভর্তি হতে গিয়ে আমার মেয়ের তিনি হয়ে উঠলেন, দাদী। ভর্তির ফরম পূরণ করতে গিয়ে মৃত্তিকা তার দাদী-শিক্ষককে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আমি সই দেবো’।
মৃত্তিকার জন্ম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে। তারিখটি ২৭, অক্টোবর, ১৯৯৯। ওকে পৃথিবীতে এনেছিলেন, ডাঃ কামরুন্নাহার। তিনি তখন মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। আমি ও ওর মা তখন সহকারী কমিশনার(ভূমি) হিসেবে কাজ করি। ওর মা ঝিনাইদহ সদরে এবং আমি কোটচাঁদপুরে। আমি সকাল সাতটায় অফিসে রওনা হই। মৃত্তিকাকে দেখার জন্য কতজনকে আনলাম, কিন্তু কেউই দায়িত্ব নিল না। দুজন বুয়ার একজন চলে গেলো বিয়ে করবে বলে, অপর জন চুরি করে চলে গেলো। হঠাৎ ওকে দেখার জন্য কেউ রইলো না। আমি তিনদিন ছুটি নিলাম, ওর মা দুইদিন, এ ভাবে একসপ্তাহ গেলো, আমরা অসহায় হয়ে পড়লাম, কেমন করে আমার মেয়েকে বড় করে তুলবো!
তখন লুনা কাজ করতো ঝিনাইদহ পৌর ভূমি অফিসের সহকারী তহশিলদার হিসেবে। লুনা অতিগুণবতী মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মহীয়সী নারী। তখন সে বিবাহিত কিন্তু সন্তান ছিলো না। আমাদের অসহায়ত্ব দেখে লুনা এগিয়ে এলো, সে তার ম্যাডামকে বললো, ‘ম্যাডাম, ভালো কেউ না আসা পর্যন্ত বাবুকে আমি দেখবো।’ লুনা সকালে অফিসে এসে, বাসায় চলে আসে, বাবুকে বুকে তুলে নেয়, ওর মা অফিসে যাওয়ার সুযোগ পায়।৷ এভাবে প্রায় একমাস বা তারও কিছু বেশী সময় কাটলো। সমস্যার কোন সমাধান হলো না। লুনা ধীরে ধীরে যেন মৃত্তিকার মা হয়ে উঠলো। নিজহাতে মৃত্তিকার জন্য কতকত জামা-প্যান্ট বানিয়ে আনে। পরায়। সারাদিন বুকে আগলে রাখে। ম্যাডাম বাসায় ফিরলে তবে ওর ফেরায় সুযোগ হয়। কিন্তু ওর ফেরার কোন তাড়াই যেন থাকে না। সাত মাস কাটলো। লুনা ক্লান্তিহীন।
মৃত্তিকার জন্মের সাতমাস পরে আমার মেজবোন জাহানারা খাতুনের তৃতীয় কন্যা নীলুফা আক্তার এলো তার বোনের দায়িত্ব নিতে, তখন সে কেবল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। নিজের পড়াশোনা রেখে একজন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সাতমাস বয়সী শিশুর দায়িত্ব নিয়ে সাড়ে এগারো বছর সেই গুরুভার বহন করে গেছে আমার ভাগ্নিটি। এর মধ্যে নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে গেছে। ডিগ্রী পাশ করেছে। তার-ই মমতায় গড়ে ওঠা বোন, আনিকা প্রিয়দর্শিনী মৃত্তিকা আজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্স এ্যাণ্ড ইন্জিনিয়ারিং থেকে সিজিপিএ ৩.৯৫ পেয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হলো।
মৃত্তিকা তখনও কথা বলা শেখেনি। আমরা ততদিনে বদলি হয়ে কুষ্টিয়া কালেক্টরেটে চলে এসেছি। নীলুফা তার বোনকে পড়ালেখা শেখানো শুরু করেছে। আমরা জানিও না। নীলুফা নিজে কাগজ কেটে বড় দেয়াল জুড়ে বাংলা ও ইংরজি অক্ষরগুলি এলোমেলো করে লাগিয়ে দিয়েছে। বোনকে খাওয়ায় আর তাকে অক্ষর চেনাতে লেগে পড়ে। মৃত্তিকা কথা বলতে পারে না কিন্তু সব অক্ষর চেনে। ওর বোন অক্ষরের নাম বলে, আর মৃত্তিকা বোনের কোলে চড়ে হাত দিয়ে অক্ষর দেখিয়ে দেয়। এভাবে কথা ফোটার আগেই আমার মৃত্তিকা অক্ষর সব চিনে ফেলে। বোনের চেষ্টায় সব অক্ষর লিখতেও শিখে যায়। তার বোনের এই উন্নতি দেখিয়ে নীলুফা আমাকে ও তার মামীকে অবাক করে দেয়।
আমি আমার মেয়ের নাম রাখি আনিকা প্রিয়দর্শিনী মৃত্তিকা। আনিকা আরবি শব্দ, বাংলায় একে “সুন্দরী” অর্থ করা যায়। আমার মেয়েটি আমার চোখে অসম্ভব সুদর্শনা বলেই আমি তাকে "প্রিয়দর্শিনী" বলেছি। এই দেশের পাললিক মৃত্তিকার প্রতি আমার ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার প্রতীক আমার কন্যা, আমি তাকে "মৃত্তিকা" বলে ডাকতে ভালোবাসি। এই দীর্ঘ ও জটিল নামটি আমার মেয়ে লিখতে শিখে যায়, তখনও তার স্কুলে যাওয়ার সময় হতে বহুদেরী।
কলকাকলি স্কুলে ২০০৪ সালে ভর্তির সময় মৃত্তিকা তার দাদী-ম্যাডামকে অবাক করে দিয়ে স্বাক্ষর করলো “আনিকা”। আমি তাকে কোলে করে স্কুলে দিয়ে আসি। তার বোন নীলুফা তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমি ও ওর মা ২০০৫ সালে মেহেরপুর জেলায় বদলি হয়ে যাই। আমি মেহেরপুর সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে, ওর মা মেহেরপুর জেলার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। মৃত্তিকাকে আমরা ভর্তি করি মেহেরপুর মিশন স্কুলে। মিশন স্কুলের শিক্ষিকাদের কাছে আমার মৃত্তিকা তার নিজগুণেই আদরণীয় হয়ে ওঠে অল্পদিনেই।
আমি ২০০৫ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য চলে আসি। আমার মেয়ে মিশন স্কুলেই থেকে যায়। ওর মা ২০০৬ সালে ঢাকায় চলে আসে, আমিও পড়া শেষ করে ঢাকায় পোস্টিং পাই। আমরা বনশ্রীর সি-ব্লকের ২৩ নম্বর বাড়িতে ভাড়াটিয়া হই, কিন্তু কিছুতেই আমার মেয়েকে কোন স্কুলে ভর্তি করাতে পারছিলাম না। আমেনার ব্যাচমেট সেলিমউল্লাহ বলে কয়ে অগ্রণী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। তখন একটু বৃষ্টি হলেই আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল প্রাঙ্গণ পানি জমে সয়লাব, আবার বনশ্রীতেও রাস্তায় হাঁটু পানি। কিন্তু যা কিছু ঘটুক আমার মেয়ে মৃত্তিকাকে স্কুলে যেতেই হবে। যেয়ে দেখা গেল কেউ আসেনি, স্কুল বন্ধ, একমাত্র আমার মেয়ে উপস্থিত। যে বাসে করে আমরা বনশ্রী থেকে আজিমপুর আসতাম, সে সব বাসের সকল সুপারভাইজার মৃত্তিকাকে চিনতো এবং সবাই ছিল তার মামা। বাসে চড়লে তার জন্য সিট নিশ্চিৎ।
আমরা থাকি বনশ্রীতে। আজিমপুর অনেক দূর। তাছাড়া বেসরকারি বাসায় থাকা ভালো লাগছিল না, আমরা বাসা বদল করে আইডিয়াল স্কুলের আসেপাশে আসবো এবং আমার মেয়েকে আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি করবো এমন আশা নিয়ে আবাসন পরিদপ্তরে হাঠাহাটি করতে লাগলাম। তখন ওর মা কাজ করতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে, আমি ততদিনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে সচিব মুহম্মদ আতাউর রহমান স্যারের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করি। ২০০৭ সাল। আমার মেয়ে প্রথম শ্রেণীতে অগ্রণী স্কুলে পড়ে। আমরা তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাবো বলে আইডিয়াল স্কুলে ফর্ম কিনতে গিয়ে জানতে পারলাম, ও বছর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছাত্র-ভর্তি করবে না। আমরা পড়লাম তুমুল দুশ্চিন্তায়।
ওর মা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপসচিব জাকির হোসেন স্যারের অধীনে কাজ করতো। আমেনা, স্যারের সাথে পরামর্শ করতে গেলে, স্যার বললেন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে যদি ভর্তি না নেয়, তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির ফর্ম নাও। আমরা জনতে পেরেছিলাম, আইডিয়াল স্কুলে, অন্য স্কুলের ২-৩ ক্লাস উপরের ছাত্র-ছাত্রী এসে ২-৩ ক্লাস নীচে ভর্তি হয়, আইডিয়াল স্কুল দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল, বাবা-মায়ের সাধ, ছেলে-মেয়ে ওখানে পড়ুক, তাই এই অবস্থা। আমরা স্যারকে বললাম, ‘স্যার, এ কি সম্ভব? ওয়ান থেকে থ্রিতে পরীক্ষা দিয়ে কি চাঞ্ছ পাওয়া সম্ভব?’ স্যার, বললেন, ‘পরীক্ষা দিক, দেখো, তোমার মেয়ে চাঞ্ছ পেয়ে যাবে।’ আমরা নিতান্ত নাচার হয়ে, অসম্ভব জেনেও, সম্পূর্ণ অবিশ্বাস নিয়ে আমরা ওর জন্য তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির ফর্ম কিনলাম।
হজের মৌসুম এসে গেলো। ২০০৭ সালের হজ। সচিব মুহম্মদ আতাউর রহমান স্যার বললেন, "তুমি এবারের হজ ম্যানেজমেন্ট টিমে যাও। 'আমি যেতে চাইনি। কিন্তু আমেনা বেগম উৎসাহিত হলো, সেও আমার সাথে নিজ-খরচে যেতে পারবে জেনে। আমি বল্লাম, ‘আমার মেয়ের পরীক্ষা।’ আমেনা বললো, ‘আল্লাহ যা করেন তাই হবে।’ আমরা আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে কয়েকটি ভর্তি গাইড কিনে আমার মেয়ে ও তার বোন নীলুফার হাতে দিয়ে মক্কা চলে গেলাম। না তাকে কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে পারলাম, না তাকে নিজেরা পড়াতে পারলাম। কেবল ভাগ্নি নীলুফাকে বলে গেলাম, ‘এত তারিখে পরীক্ষা, তুমি নিয়ে যেও।’ তখন আকাশ আব্দুল্লাহ সিদ্ধার্থ অনেক ছোট। তাকে বাসায় রেখে যাওয়া সম্ভব না, নিয়ে যাওয়াও বিপদজনক, কিন্তু আমাদের কোন উপায় ছিলো না। নীলুফার হাতে ওদের ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা দুজনই মক্কা চলে গেলাম।
বাচ্চাদের রেখে গেছি, দুজনই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল। রোজ কথা বলি। একদিন হঠাৎ নীলুফা জানালো, মৃত্তিকা, আইডিয়াল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে, এবং নীলুফা তাকে ভর্তি করিয়েও দিয়েছে। আমাদের আনন্দের ও বিষ্ময়ের সীমা ছিলো না, সীমা ছিল না মহান আল্লার কাছে কৃতজ্ঞতারও। একটা ছোট্ট বাচ্চা, বাবা-মা তার সাথে নেই, কোন কোচিং সেন্টারে পড়া নেই, পড়ে মাত্র ক্লাস ওয়ানে, তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় তার চেয়ে বয়সে বড় ও উঁচু শ্রেণিতে পড়া সকলকে পশ্চাতে ফেলে কেমন করে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ করে নিল! আইডিয়াল স্কুলে মৃত্তিকা অত্যন্ত প্রিয় ছিল তার শিক্ষকদের কাছে, বন্ধুদের কাছে। বরাবারই ভালো ফলাফল করে উত্তীর্ণ হয়েছে শ্রেণি থেকে শ্রেণি। যে কোন পরিস্থিতিতে স্কুলে তাকে যেতেই হবে, কোন বাধাকেই সে বাধা মনে করেনি।
তার দাদা, মোঃ নওশের আলী বিশ্বাস, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমি আমার জীবনে এতটা নিবেদিত শিক্ষক দেখিনি। কিন্তু মৃত্তিকা তার দাদাকে দেখার সামান্য সুযোগ পেলেও দাদার সাহচর্য সে পায়নি কিন্তু ঐ ছোট্ট বেলায় সে শিক্ষকতার অভিনয় করে দেখিয়েছিল, সে শাড়ি পরে বেগম রোকেয়া সেজেছিল, তখন সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তার মেজখালা, মেজখালু, খালাত বোন, মামাত ভাই, সবাই ডাক্তার হওয়ায়, ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার, কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে মত বদলে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে স্থির করলো। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে জিপিএ ৫ পেয়ে এএসসি ও এইচএসসি পাশ করলো, তার স্বপ্ন সে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পড়বে। আমরা তাকে দূরে পাঠাতে চাইনি। অন্য কোথাও ভর্তি না হয়ে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্স এ্যাণ্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হলো সে।
বরাবর ভালো ফলাফল করে পড়াশোনায় এগিয়ে যাচ্ছিল, দিন নেই, রাত নেই, পড়ার বাইরে থাকার যেন কোন উপায়ই নেই। হয় ক্লাসের পড়া, নয়তো সৃজনশীল সাহিত্য। তৃতীয় বর্ষে থাকতেই সে স্টুডেন্ট টিউটর হিসেবে পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আয় করতে শুরু করলো। বাবার উপর চাপ না পড়ে, তাই মেয়েটি আমার, নিজের উপর প্রবল চাপ তুলে নিল। তখন থেকেই তার বিভাগে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো এবং তার শিক্ষকদের কাছ থেকে ধারণা পেতে শুরু করলো, যদি তার রেজাল্ট ধরে রাখতে পারে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে। স্নাতক শেষ করার পর, কনট্যাকচুয়াল শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তির সময় এলে আমার মেয়ে তার স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্খায় পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হলো।
আমার মেয়ের সেই কান্না মনে পড়লে আমি আজও বিচলিত হয়ে পড়ি। আমি তাকে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখিনি। কয়েকদিন খুবই বিপন্নবোধ করলো, আমি যতই বুঝাই, সে কিছুতেই প্রবোধ না। এরপর পর একদিন সে হঠাৎ বললো, ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি হবোই।’ আবার প্রস্তুতি শুরু হলো। এবং পরের বার সে কনট্যাকচুয়াল শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলো। এক সেমিস্টার যাওয়ার পরই রেগুলার প্রভাষক হিসেবে সে নিযুক্ত হলো। তার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে। আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া।
আমার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার স্বপ্ন ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো, ঋণাত্মক সময়ের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার সে লালিত স্বপ্ন। কিন্তু আজ আমি সুখী। আমার কন্যা আমার স্বপ্নকে সত্য করে তুলেছে। আমার আনন্দ আজ বলে বুঝানোর মত নয়। আজ যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতেন, তার চেয়ে সুখী আর কেউ হতো না। আব্বা, আপনি বেহেশতে বসে দোয়া করুন, আপনার মৃত্তিকা আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে, সে যেন আরও আরও আরও বড় হতে পারে, যেন এই পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
আজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ছিলো। আমার মৃত্তিকা ছাত্র হিসেবে আকাশী রঙের গাউন পরেছে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সবুজ রঙের গাউন পরেছে। আমার জন্য এ এক অভাবনীয় বিরল দৃশ্য। প্রিয়তম দৃশ্য। সুখের দৃশ্য। চোখ সার্থক করা দৃশ্য। আমার মেয়ে, আমার মা, আমার মৃত্তিকা, এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন হয়ে উঠুক, এ ছাড়া মহান আল্লার নিকট আজ আমার অন্যকোন দাবী নেই।"
১৮৬ বার পড়া হয়েছে