তক্ষশিলা, সুব্রত ও আমি
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ৯:৫০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
গতকাল স্নেহাষ্পদ ছোটভাই সুব্রত ভট্টাচার্য বাসায় এসেছিল। ও আমার এলাকার। পরিচয় তক্ষশিলায়। বইয়ের দোকান তক্ষশিলা। আজিজ সুপার মার্কেটে। শাহবাগ মোড় থেকে একটি পশ্চিমে এগুলেই। সেলিমা আপা যার কর্ণধার। সেলিম, মেজবাহ, শাহীন, যার হৃদয়। আমি মাঝে মাঝে নতুন বইয়ের খোঁজে যাই। সুব্রত-এর সাথে প্রথম সেখানেই দেখা।
সুব্রত বইপড়া সমাজতন্ত্রী। জানাশোনা। প্রজ্ঞাবান। বয়সের চেয়ে বেশী পাকা। অগাধ পাণ্ডিত্য। অবাধ জ্ঞানের প্রবাহ। এ সব জেনেছি পরে। সুব্রতের সাথে আমার ঝগড়া দিয়ে শুরু। আমি সরকারী কর্মচারী। সরকারী লোকের বিরুদ্ধে বললে আমার গায়ে লাগে। সেদিন লেগেছিল বেশ কড়াভাবে। তার সমাজতন্ত্রী চোখালো গুতা আমার সহ্য হয়নি। সেও ছাড়বার পাত্র নয়, আমিও নই। বেশ ছোটখাট কলহের পর যে যার পথ ধরি।
মেজাজ খিঁচিয়ে যায়। বাসায় এসেও মন কেমন-কেমন করছিল। বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। অভ্যাসমত তক্ষশিলা গেলে, শাহীন বলে, "স্যার, সুব্রত দাদা আপনার নম্বর চাইছিলেন, তিনি কথা বলতে চান। আমি কি তাকে আপনার নম্বর দিতে পারি?' আমি বললাম, "কি আর বলবেন! আচ্ছা, দিও।" আমি আশা রাখিনি যে, সত্যি-সত্যি সুব্রত আমাকে ফোন করবেন।
কিন্তু সুব্রত আমার ধারণা মিথ্যে করে দিয়ে, আমাকে ফোন দিলেন। সহজ স্বাভাবিক অনেক কথা হলো। জানলাম, ওর বাড়ি খুলনা। আমি যশোরের মানুষ। ও আমার এলাকাই ছোটভাই। অনেক বুদ্ধিদীপ্ত। কথা বলে চমৎকার ভঙ্গিমায়। বিপুল ওর পড়াশোনা। ওর সাথে আমার সব বিষয়ে মতের মিল না হলেও, ওর প্রজ্ঞার পরিধি বিবেচনায়, ওকে না ভালোবেসে পারা যায় না। ওর কথার পর ওর উপর আমার মায়া পড়ে গেলো। তারপর থেকে তক্ষশিলায় দেখা হয়,কথা হয়, নানা বিষয়ে আলোচনা হয়, আর মেজবাহ-র চা, নয়তো কফি, সাথে বিস্কুট, নয়তো হাড়ের মত শক্ত টোষ্ট চলতেই থাকে।
কখনও সেলিমা আপা তাঁর গোপন ভাণ্ড থেকে এটা-ওটা বের করে সস্নেহে বাড়িয়ে দেন, আমরা সাবাড় করতে লজ্জা করিনে। মনে হয়, তক্ষশিলা আমাদেরই। সেলিমা আপা মায়ের মত বড় বোন। তার ভাণ্ডার উজাড়ে আমাদের আর লজ্জা কি!
সেলিমা আপা যশোরিয়ান। আমাকে ছোটভাই বলে স্বীকৃতিও দিয়েছেন। এই স্বীকৃতি পেয়ে আমাদের লাজ-লজ্জাও উধাও।
বইয়ের দোকান আর বইয়ের পাঠকের এমন মধুর সম্পর্ক খুব কমই দেখা যায়। পাঠকই ক্রেতা, ক্রেতাই পাঠক। বইয়ের দোকান যেন, ক্ষুধার্ত পাঠকের মায়ের সঞ্চিত সুখাদ্যের ভাণ্ডার। গুণবান সেলিম-মেজবাহ-শাহীন তক্ষশিলার সম্পদ। বই বিক্রিকে ওরা শিল্পে রূপান্তর করেছে। বয়সে ওরা নবীন, কিন্তু গুণে, শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য। কার কি ধরণের বইয়ের প্রতি পক্ষপাত, ওরা মনে রাখে, চায়ের ফাঁকে ফাঁকে নতুন কি বই এলো, যার যা পছন্দ, তাকে তা দেখার সুযোগ করে দেয়।
বই না কেনার মন নিয়ে গেলেও প্রায়শ-ই কোন-না-কোন বই হাতে করেই ফিরি, মন কখনও বলে না, আহা! না কিনলেই হতো! মাঝে মাঝে তুমুল আনন্দ হয়, যখন দেখি, কবে একটা বইয়ের নাম করেছিলাম, আমিই ভুলে গেছি কিন্তু ওরা মনে রেখে ঠিকই আমার হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এত যত্নশীল যারা, তাদের কেবল বই-বিক্রেতা বলা চলে না, তারা মূলত বই-বিক্রয়-শিল্পী। ঝগড়ার পর, আমার ও সুব্রত-এর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার মূল কারিগর মূলত ওরাই।
সুব্রত, সন্ধ্যায়, ফোন দিয়ে বললো, ভাইয়া, আমি কারওয়ান বাজার। কদিন থেকে দেখা হয় হয় কিন্তু হচ্ছে না। আমি বললাম, চলে এসো। বাসায় দীর্ঘ আড্ডা হলো। সাহিত্য-সংস্কৃতি, বইয়ের জগৎ, বই নিয়ে কোলকাতা-ঢাকার তুলনা, এবারের বইমেলার বিশেষত্ব, মেলায় যাওয়া-না-যাওয়া, বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, তাদের পূর্বের ও পরের সাহিত্য, কিঞ্চিৎ রাজনীতি, কত কি নিয়ে যে আলাপ হলো! মাঝে এসে যুক্ত হলেন, ওর ভাবী, আমেনা বেগম। সামান্য নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে সুব্রত ও তার ভাবী একপক্ষ নিলে আলাপ বেশ জমেই উঠলো।
বেশ রাত হয়ে এলো। সুব্রত উঠতে চাইলো। আমার বইয়ের সংগ্রহ দেখে, ও খুব খুশী হলো। ঘুরে ঘুরে দেখলো। বিদায় বেলায়, আমার 'কবিতা-সংগ্রহ"-এর একটা কপি সুব্রত-এর হাতে দিলাম, তার ভাবী ছবিটা তুলে স্মৃতিময় করে রাখলো।
লেখক: গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অবসরপ্রাপ্ত সচিব।
১০৪ বার পড়া হয়েছে