সাংবাদিক যখন বিড়াল অথবা সিংহ

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ ৯:৫১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সাংবাদিকতায় রাজনীতি ঢুকে গেছে কিংবা সাংবাদিকতা আত্মসমর্পন করেছে রাজনীতির কাছে—এমন কথা শুনলে আগে অনেকেই অবাক হতো, দুঃখিত হতো। কিন্তু গত কয়েক দশকে যা কিছু ঘটেছে দেশে, এখন আর এই বাক্যগুলো অবাক করা কিছু নয়।
যেন মনে হয়, এটাই তো স্বাভাবিক। রাজনীতি যখন সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তখন সাংবাদিকতাকেই বা নয় কেন? মানুষ যখন কোন সাংবাদিককে দেখে, অবধারিতভাবেই তার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আসে সেটা হচ্ছে—উনি কোন লাইনের? আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী নাকি জামায়াতপন্থী? তাহলে কোন না কোন পন্থী হওয়াটা কি এখন সাংবাদিকতার জন্য অপরিহার্য?
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, সেটা সেই আশির দশকের কথা, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে খুব বেশি জড়িত ছিলাম। বামপন্থী রাজনীতি করতাম। ক্লাসে নিয়মিত দেখা যেত না, বেশি সক্রিয় থাকতাম মধুর ক্যান্টিনে, কলাভবনের বারান্দায়, বা উত্তেজিত মিছিলে। মাস্টার্সের ভাইভা পরীক্ষা দিতে যেয়ে একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। তখন সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন কিউ এ আই এম নুরউদ্দিন। তিনি ছাড়াও ভাইভা বোর্ডে ডিপার্টমেন্টের জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক শাখাওয়াত আলী খান ছিলেন। আরও একজন ছিলেন, কিন্তু এতদিন পর তার নামটা মনে করতে পারছি না। মনে আছে দুটি মাত্র প্রশ্ন আমাকে করা হয়েছিল। প্রথম প্রশ্নটি করেছিলেন নুরউদ্দিন স্যার। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্র?
আমি বিস্মিত, কিছুটা অপমানিতও। বললাম, আমি তো এই বিভাগেরই।
তিনি একটু মোলায়েম স্বরেই বললেন, কিন্তু তোমাকে আমি ক্লাসে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
আমি ক্লাস কম করতাম, সেটা ঠিক। কিন্তু একেবারেই করতাম না, সেটা বোধকরি ঠিক নয়। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করলাম না। বিভাগের শেষ পরীক্ষা বলে কথা। চুপ করে থাকলাম। স্যার তখন বললেন, তবে ক্লাসে না দেখলেও করিডোরে বেশ কয়েকদিন তোমাকে দেখেছি মিছিলের মধ্যে, শ্লোগান দিতে।
প্রশ্ন করার দায়িত্ব এবার শাখাওয়াত স্যার নিয়ে নিলেন। বললেন, আচ্ছা বলতো, একজন সাংবাদিক যদি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকে, সেটা তার জন্য সবচেয়ে বড় কী ক্ষতি করতে পারে?
তাঁর এই প্রশ্নের কী উত্তর সেদিন আমি দিয়েছিলাম, এতদিন পরেও আমার ঠিক মনে আছে। কিন্তু আজকের এই লেখার জন্য সেটি প্রাসঙ্গিক নয়। বরং প্রাসঙ্গিক হচ্ছে, পিতৃপ্রতীম দুই শিক্ষকের সেই কথাগুলো আমার মধ্যে যে পরিবর্তনটি এনেছিল, সেটি।
আমি বুঝলাম, রাজনীতি ও সাংবাদিকতা দুটি একসঙ্গে চালানো যাবে না। চালানো উচিত হবে না। যে কোন একটা করতে হবে। আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ, তাই ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতির দিকে আর গেলাম না। পেশা হিসাবে সাংবাদিকতাকেই নিলাম। আর মাথার মধ্যে ঢুকে গেল সেই শিক্ষাটি—সাংবাদিক নিজে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে তার লেখার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে, পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা থাকবে। সাংবাদিকরা কোনও পন্থী হবে না, ডানপন্থী বা বামপন্থী কোনটাই নয়। সাংবাদিক রাজনীতি সচেতন হবে, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে যাবে না।
কিন্তু সক্রিয় সাংবাদিকতা করতে এসে বছর কয়েকের মধ্যেই ভুল ভাঙতে শুরু করল। সামরিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানের পর, ৯১ এর নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ যখন গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা শুরু করল, এর পরই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সংবাদিকতায় রাজনীতির ন্যাক্কারজনক প্রভাব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাসদসহ বামপন্থী—এরকম নানাভাগে বিভক্ত হতে থাকল সাংবাদিকগণ। দলবাজির চুড়ান্ত চেহারা প্রকট হয়ে গেল এই সময়েই। খালেদা বা হাসিনাকে খুশি করতে প্রকাশ্যে বিভক্তি এল সাংবাদিক ইউনিয়নে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, দুটি সংগঠনই ভেঙে দুটুকরা হয়ে গেল। সেই থেকে শুরু, এরপর যত দিন যেতে থাকল এই বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়ে গেল।
সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ সময় ছিল গত দেড় দশক। আওয়ামী লীগের একচেটিয়া শাসনের এই দুঃসময়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কতিপয় সাংবাদিকের আচার আচরণ, কর্মকাণ্ড ছিল পুরোই রাজনৈতিক পাণ্ডাদের মতো। শাসক গোষ্ঠীর সামনে যখন তারা যেতেন, আচরণ করতেন অনুগত ভৃত্যের মতো। ভৃত্যসুলভ এই আচরণ আবার নির্লজ্জের মতো দেখানো হতো সাধারণ মানুষকে, অন্যান্য সাংবাদিকদের। স্বৈরশাসক বিদেশ থেকে এসে নিয়ম করে সাংবাদিকদের নিয়ে বসতেন। নাম ‘সাংবাদিক সম্মেলন’ হলেও সেটা ছিল একটা প্রতিযোগিতা মঞ্চ। সাংবাদিকরা প্রধান মন্ত্রীর সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে মোসাহেবীর নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো। টেলিভিশনে জনগণ সেসব দেখে ধিক্কার দিত, ছিছি করত। কিন্তু তাদের এতে যায় আসত না। বরং তারা এটাকে তাদের যোগ্যতা বলে বিবেচনা করত। ভাবত—যত বেশি ধিক্কার, তত বেশি প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা।
একটা ঘটনা বলি, এ বছরের (২০২৪) ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসের কথা। রাতে একটা টেলিভিশনের টকশো শেষ করে লিফট দিয়ে নামছি। আমার সঙ্গে সহআলোচক হিসাবে থাকা সিনিয়র সাংবাদিক লিফটের মধ্যেই আমাকে বললেন, সরকারের এত দালালি করছি, তবুও কিছু পেলাম না। একটা টেলিভিশনের জন্য চেষ্টা করছি, দিচ্ছেই না! আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বুঝলাম—পূর্ববর্তী ঘন্টাখানেক ধরে তিনি সরকারের পক্ষে যে নগ্ন দালালি করেছেন, তিনি হয়ত ভেবেছেন তার কথাবার্তায় আমি বুঝি বিস্মিত হয়েছি, তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যই লিফটের মধ্যে আমাকে একা পেয়ে কথাগুলো বললেন। সে রাতে আমি আর তাকে বলিনি—পর্দায় তার কথায় আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। কারণ এদেরকে আমি চিনি, এদের অধঃপতিত চরিত্রও আমার ভালোভাবেই জানা। ওই দালালিটুকু না করলেই আমি বরং বিস্মিত হতাম। তবে সেদিনের না পাওয়ার বেদনাধারী আমার সেই ‘বড়ভাই’ পরে অবশ্য সুদে আসলে অনেক কিছুই পেয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী প্রেস সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওনার এত বড় একটা পদের আমোদ দুইমাসও ভোগ করতে পারেননি।
দেশে সরকার পাল্টে গেছে। স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দেশে এখন নির্দলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকার। নতুন কোন রাজনৈতিক সরকার এখনও রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব পায়নি। কিন্তু ‘অগ্রবর্তী গোষ্ঠী’ হিসাবে সাংবাদিকদের মধ্যে কিন্তু দখলদারির প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যে সকল আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা আগে ভোগ করত, সেসব এখন হস্তান্তরিত হয়ে গেছে বিএনপি-জামায়াত পন্থীদের কাছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নতুন লোক এসে বসছে। সাংবাদিকতায় তাদের যোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আমি করছি না, তবে লক্ষণীয় হচ্ছে তারা এই পদগুলোতে বসতে পারছে কেবলই দলীয় বিবেচনায়। কেবল তাই সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু করে এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রেসক্লাবেও চলছে নির্লজ্জ দখলদারিত্ব। এই কার্মকাণ্ড, এসব কি সাংবাদিকদের কাজ? এসব করার জন্যই কি তারা এই পেশায় এসেছেন? তত্ত্বগতভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক না কেন, বাস্তবে আসলে এটাই চলছে। তারা যতটা না সাংবাদিক, তার চেয়ে বেশি কোন একটি দলের অনুগত সাংবাদিক। সেই দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন তারা বিড়াল, যখনই সেই দলটি ক্ষমতায় চলে আসে কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসলে তখনই তারা রাতারাতি পরিণত হয় সিংহে! তারা কখনোই পেশাদার সাংবাদিক থাকতে চায় না, থাকতে চায় সিংহ অথবা বিড়াল হয়ে। এতে করে তাদের হয়তো ব্যক্তিগত লাভ অথবা ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু যে কারণে তারা এই পেশায় এসেছে, একটা ন্যায়-নীতির সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য, সেই প্রধানতম উদ্দেশ্যটাই মর্মান্তিকভাবে ব্যহত হয়।
লেখক: খ্যাতিমান সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
৪৯৪ বার পড়া হয়েছে