সর্বশেষ

ফেবু লিখন

হেলাল হাফিজ : ‘একজন মুগ্ধ শুধু বসে আছে হোটেলের ঘরে’

মাহমুদ হাফিজ
মাহমুদ হাফিজ

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১২:৩৮ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
লোকে তাকে বলে 'বিরলপ্রজ' । শব্দটি উচ্চারিত হলে এর নিশানার ধনুক তাঁর দিকেই তাক করে। একটি মাত্র বই প্রকাশের পর তিনি আপামরের ভালবাসায় সিক্ত, কবির কবি।

ভরজীবন কাটিয়ে চলেছেন কবিজীবন। সংগ্রামী, নি:সঙ্গতালোভী, বিষন্নপ্রিয় এবং অন্তরালপরায়ণ। প্রেম-বিরহের সঙ্গে যার নাম যুক্ত। তিনি কবি হেলাল হাফিজ, পরমশ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ আমার। 'মাহমুদ হাফিজ' আপনার ভাই কিনা এমন জিজ্ঞাসায় তাঁর সাফ উত্তর, হ্যাঁ, ভাইই তো, ভাইয়ের অধিক।

ভরজীবন হোটেলে কাটিয়ে দেয়া সৃষ্টিশীল মানুষ পৃথিবীতে কে কে আছে এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। গুগলিং করলে অনেক কিছুই হয়তো পাওয়া যাবে। হেলাল হাফিজ এমন একজন, যিনি পারিবারিক আয়েশ গ্রহণ করতে পারেননি। জীবনে একাকীত্বের প্রয়োজনে সঙ্গী করে নিয়েছেন নি:সঙ্গ-কষ্টকর জীবন। কাব্যের সঙ্গে জীবনযাপন। অধরা সৌন্দর্য ও প্রেমাস্পদকে না পাওয়ার বেদনা কাউকে যে কবিতাযাপনে প্রলুব্ধ করে, হেলাল হাফিজকে না দেখলে তা বোঝা যায় না।
কবি জয়গোস্বামীর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘হোটেলের ঘরে একজন’এর শেষ স্তবক হচ্ছে ‘একজন মুগ্ধ শুধু বসে আছে হোটেলের ঘরে’। কবি হেলাল হাফিজ হোটেলের ঘরে মুগ্ধ থাকেন কিনা জানা নেই, কিন্তু একাকীত্ব ও কবিজীবন উদযাপনে হোটেলবাস থেকে তাঁর জীবনকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি নারীকূলও। এ গদ্য লেখার সময়ও কবি বাস করছেন শাহবাগ এলাকার সুপারহোম হোস্টেলে। পয়লা জুলাই ২০২১ থেকে শুরু হয়েছে তার এই নতুন হোটেলবাস। বললেন, ‘আলস্য আমার কাছে নারীর চেয়েও প্রিয়। আলস্য ও একাকীত্ব খুব উপভোগ করি। কিন্তু বর্তমান হোটেলবাসে নি:সঙ্গতা ও একাকীত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে।‘

‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবি হেলাল হাফিজ ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে হোটেলজীবনকে জীবনের অণুষঙ্গ করেন। তার বাস ও সৃজনশীলতার আস্তানা হয়ে ওঠে তোপখানা রোডের হোটেল কর্ণফুলি ও জাতীয় প্রেসক্লাব। চিরকুমার কবি ভরজীবনই একাকী, নি:সঙ্গ। ১৯৭১ সালে লেখাপড়া শেষ হয়ে গেলেও অতিরিক্ত চারবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কাটান। ১৯৭৫ সালে হল ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ওঠেন পুরানা পল্টনের ভাড়া বাসায়। জীবনের দীর্ঘসময় তিনি কখনো একা, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে ভাড়া বাসায় কাটান। পরে হোটেলে কর্ণফুলিই হয়ে ওঠে কবির রাত্রিবাসের আস্তানা।
২০১১ সালের অক্টোবর মাস থেকে টানা নয়বছর কবি হেলাল হাফিজ কাটিয়েছেন হোটেল কর্ণফুলিতে। তোপখানা সড়কে জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকের গলিতেই হোটেলের অবস্থান। কবি সাংবাদিকতা পেশার মানুষ বলে জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য। সাংবাদিকতা জগতের মানুষ তার পরিচিত আপনজন। এ সুবাদে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তিনি পরিচিত বন্ধুবান্ধব সমবায়ে কাটাতেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। সকাল আটটার আগে ক্লাবে চলে আসতেন । নাস্তা সেরে দোতলার লাইব্রেরী বা তৃতীয়তলার মিডিয়া সেন্টারের কম্পিউটারে বসতেন। দুপুরে দোতলা থেকে নিচে নেমে মধ্যাহ্নার সেরে একটু বিশ্রামে থাকতেন। কখনো বন্ধু শুভানুধ্যায়ীরা এলে দেখা সাক্ষাৎ করতেন। পরে আবার লাইব্রেরী বা মিডিয়ারুমের কম্পিউটারে সোস্যাল মিডিয়ায় জনসংযোগ ও লেখাপড়া করতেন। রাতের খাবার শেষে রাত্রিযাপনে ফিরে যেতেন কর্ণফুলির কক্ষে। প্রেসক্লাবে তিন-চারবেলা আহারের ব্যবস্থা থাকায় কবির খাওয়ার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়নি। তাছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ভক্ত শুভানুধ্যায়ীরা কোন না কোন তরকারি, পিঠা বা মিষ্টি নিয়ে আসতেন কবির জন্য। অন্তরঙ্গে একাকী হলে বহিরঙ্গে একাকীত্বের যন্ত্রণাটা টের পাননি।

২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হলে প্রেসক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। কবির খাওয়া দাওয়া দিনমান সময় কাটানোর দরজাও বন্ধ হয় এই সঙ্গে। করোনাকরুণ দিন মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে, গৃহবিবাগী কবির জীবন যাপন হয়ে পড়ে আর দুর্বিসহ । পরিস্থিতির আলোকে কবিকে কাটাতে হয় অগ্রজের বাসায়। সেখানে ১৫ মাসের মতো তিনি থাকেন। তারপর লকডাউন শিথিল হলে কবি আবার একাকীজীবনকে বেছে নেন। প্রেসক্লাব বন্ধ থাকা অবস্থায় গিয়ে ওঠেন শিল্প সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে, চীনা মালিকানায় পরিচালিত হোটেল সুপারহোমে। এখন তাঁর অবস্থান এই হোটেলেই।

হোটেলজীবন সম্পর্কে একান্ত আলাপচারিতায় কবি বললেন, গৃহী ও হোটেলজীবনের মধ্যে সুবিধা অসুবিধা দুইই আছে। সংসারজীবন যন্ত্রণার পাশাপাশি আনন্দও আছে। হোটেলজীবন একাকী, শুধুই আনন্দহীন। একাকী বাসায় থাকার চেয়ে তা সুবিধাজনক এ জন্য যে এখানে সবকিছু রেডিমেড পাওয়া যায়। নি:সঙ্গ ও একাকীজীবন তো আর পরিকল্পনা করে মানুষ বেছে নেয় না। জীবনই কাউকে না কাউকে এখানে নিয়ে আসে। তার হোটেলজীবন ও একাকীজীবন পরিকল্পনা করে বেছে নেয়ার কোন ব্যাপার নয়। যে কোন কারণেই হোক সংসার ভাগ্যে ছিল না। ভরজীবনই কাটিয়েছেন অনেকটা নি:সঙ্গ, একাকী। উপভোগও করেছেন। তবে জীবনের প্রান্তবেলার এ সময়ে হোটেলজীবনের নি:সঙ্গতা তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক। তোপখানায় থাকতে দিনমান কাটতো প্রেসক্লাবের পরিচিত আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। ভক্ত শুভানুধ্যায়ীদের আনা বাসার খাবারের আস্বাদ গ্রহণ করে। এখানে চব্বিশ ঘন্টাই একাকী, কথা বলার কোথাও কেউ নেই। তিনবেলায় হোটেলের একই স্বাদের খাবার।

হোটেলজীবনের সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে কবি বলেন, হোটেলজীবনে তিনি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি হোটেল থেকেই তৈরি। তাছড়া ‘কবিতা একাত্তর’ ও ‘একজীবনের জন্ম যখম’ নামের বই ও অনুবাদগ্রন্থের পরিকল্পনা ও কাজ প্রেসক্লাব আর হোটেলজীবনেই হয়েছে। তাই হোটেলজীবনে সৃষ্টিশীল নয় তা বলা যাবে না।
সাহিত্যে কবিদের হোটেলবাস কিংবা হোটেলকেন্দ্রীক সাহিত্য সৃজন-আড্ডার এন্তার ইতিহাস আছে। আলোচ্য কবি হেলাল হাফিজের মতো কেউ লাগাতার হোটেলবাস করেছেন কিনা তা অবশ্য জানা যায় না। পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে পঞ্চাশ-ষাট দশকের যেসব কবি সাহিত্যিক শিল্পীগণ আড্ডা দিতেন, তারা সবাই প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন নিজ নিজ প্রতিভাগুণে। এখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিখ্যাত সব সাহিত্য। কবি শামসুর রাহমান নাকি তার প্রথম কবিতা বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই লিখেছিলেন। আলাউদ্দীন আল আজাদ, আনিসুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, ফজল শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক,আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ফয়েজ আহমদ, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ কবি এখানে আড্ডা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অমর সব সৃষ্টি।

বিশ্বসাহিত্যের বহু মণীষী হোটেলজীবনকে সঙ্গী করে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব সৃষ্টি। বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক আর্ণেস্ট হেমিংওয়ে বহুদিন হোটেলে কাটিয়েছেন। ফ্রান্সের আর্তুর র‍্যাঁবো খুব অল্পবয়সেই খ্যাতি পেয়ে লেখাজোঁকা ছেড়ে বোহেমিয়ান হয়ে পড়েন এবং হোটেলে হোটেলে ভ্রমণ করে কাটান। মার্কিন সরকার ক্যালফোর্নিয়ার হোটেল ডেল করোনাডোকে হিস্টোরিক সাইট হিসাবে ঘোষণা দিয়ে সংরক্ষণ করছে, কারণ লেখক এল ফ্রাংক বাউমস এখান থাকাকালীন উনিশশতকে লিখেছিলেন উপন্যাস ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অব ওজ’। রিচার্ড ম্যাটার্সন একই হোটেলবাসের সময় লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিড টাইম রিটার্ণ’।

আমাদের বিরলপ্রজ কবি হেলাল হাফিজ এর হোটেলজীবন বাংলা সাহিত্যে অনন্যই বলতে হয়। আর কোন কবি এভাবে গৃহীজীবন না গ্রহণ করে বছরের পর বছর এভাবে নি:সঙ্গ হোটেলজীবন বেছে নিয়েছেন বলে তথ্য নেই। কবির জীবনের দীর্ঘসময় বাসের হোটেলগুলো হিস্টোরিক সাইট হবে কি না তা হয়তো ভবিতব্য জানে।

পুনশ্চ: হোটেলজীবন সাঙ্গ করে শুক্রবার কবির প্রস্থান অনন্তলোকে...।

লেখক: খ্যাতিমান কবি, সাংবাদিক ও ভ্রমণলেখক

হেলাল হাফিজ
হোটেলের ঘরে

১৪৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
ফেবু লিখন নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন