বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে ডেসকো'র রাজা হতে চেয়েছিলেন এসডিই হাফিজুর!
বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১১:০৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
অফিসে না করেও দিনের পর দিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) বহুলালোচিত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান (স্বাধীন)।
১৪৬৮ নং আইডিধারী এই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ (বিপিপি), ডেসেকোর সাধারণ সম্পাদক। হাফিজুরের সকল অপকর্মের দোসর ও মদদদাতা নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল হাসান চৌধুরী (আইডি নং ৮৯৯)। সরকার পতনের পর গত ৮ আগষ্ট ১৭৮৩ নং স্মারকের এক অফিস আদেশে হাফিজুরকে জনগুরুত্বপূর্ণ প্ল্যানিং এন্ড ডিজাইন বিভাগ থেকে মিরপুরের সেন্ট্রাল স্টোর ডিভিশনে বদলি করা হয়। এছাড়া এর ৩ দিনের মাথায় ১১ আগষ্ট অপর ১৮০২ নং স্মারকে বিপিপি’র অন্যতম নেতা নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল হাসান চৌধুরীকেও আইসিটি বিভাগের স্পর্শকাতর ডাটা সেন্টার থেকে সেন্ট্রাল স্টোর বিভাগে বদলী করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাপক দূর্ণীতি ও অর্থলোপাটের মাধ্যমে বিতর্কিত এই ডাটা সেন্টারের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পলাতক সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গং। এদিক, গত ৫ আগষ্ট ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতনের পর সেন্ট্রাল স্টোর বিভাগ মূলত; ডেসকো’র ডাম্পিং সেন্টারে পরিণত হয়।
রাজত্ব করতে চেয়েছিলেন হাফিজুর:
একাধিক সূত্র অভিযোগ করে জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আশীর্বাদে ডেসকো'র রাজা হতে চেয়েছিলেন চরম বিতর্কিত, দুর্ণীতিবাজ ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ (বিপিপি), ডেসেকোর সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর। ফ্যাসিববাদী সরকারের সময় তার দাপটে সবসময় তটস্থ থাকতেন বিভিন্ন বিভাগের সহকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কয়েকদিন ঘাপটি মেরে থাকলেও সম্প্রতি আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছেন তিনি। তবে এবার খোদ তাকে সরাসরি সহযোগীতা করছেন সেন্ট্রাল স্টোর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল হাসান চৌধুরী। হাফিজুরকে স্টোর ডিভিশনে বদলী করা পর থেকে গত চারমাসে অফিস করেছেন সপ্তাহে মাত্র ১/২ দিন। সপ্তাহের বাকী অনুপস্থিতির ৩/৪ দিনের হাজিরাখাতায় স্বাক্ষর তিনি করেন উপস্থিতির ওই ১/২ দিনে। অফিসের অন্যান্য সহকর্মীরা বিষয়টিতে বার বার তীব্র আপত্তি জানালেও নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল সবসময় মদতদান করে তার পক্ষেই কথা বলে সাফাই গেয়ে আসছেন। সময়মত অফিসে এসডিই হাফিজুরের উপস্থিত এবং অনুপস্থিতির বিষয়ে এক্সইএন হাবিবুলকে অফিসের সকলস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বহুবার অবহিত করেন। কিন্তু "কথা হয়েছে, অফিসের কাজে বাইরে আছেন, তিনি সব জানেন। কোন সমস্যা নেই!" এভাবেই কথা বলে তিনি সবসময় সহকর্মীদের নিকটে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এরপর তিনি যখনই অফিসে আসেন অনুপস্থিত দিনগুলোও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন এক্সইএন হাবিবুল।
সিসিটিভি'র ফুটেজে প্রমাণ:
গত ১৩ আগস্ট সেন্ট্রাল স্টোর ডিভিশনে যোগদানের পর থেকে কোনদিনই যথাসময় এমনকি অফিসেও আসেননি হাফিজুর। কিন্তু নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। আর এই অনিয়মের সরাসরি সহযোগিতা করে চলেছেন স্বয়ং এক্সইএন নিজেই। সূত্র বলছে, হাফিজুর ও হাবিবুলের বহু অনিয়মের প্রমাণ সেন্ট্রাল স্টোরের সিসিটিভি'র ফুটেজ চেক করলেই পাওয়া যাবে। এছাড়া গত ৭ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলী মো: গোলাম রাব্বানী সেন্ট্রাল স্টোর ডিভিশন পরিদর্শনে যান। সেদিনও আলোচিত হাফিজুর রহমান (স্বাধীন) কর্মস্থলে অননুমোদিত অনুপস্থিত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন গত ২ ডিসেম্বর।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি নেই হাফিজুরের:
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতিহীন জীবনযাপন করেন হাফিজুর রহমান (স্বাধীন)। পেশায় ডেসকো'র একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হলেও তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনহীন দামি প্রাইভেট কার ব্যবহার করেন নিয়মিত। যেটি ঢাকা মেট্রো গ- ৩৫-০৬৯২ সিরিয়াল নম্বরের প্রিমিও কারের মূল্যবান গাড়ি। এই গাড়িতে করেই তিনি অফিস যাতায়াত করেন। সেন্ট্রাল স্টোরের মধ্যে গাড়িটি পার্কি করে রাখা থাকে। অনেকের কাছেই গাড়িটি তার নয়, শ্বশুরের বলে তথ্য দেন তিনি। কিন্ত মিরপুর বিআরটিএ অফিস সুত্রে জানা গেছে, গাড়িটি হাফিজুরের নামেই এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর দিয়েই রেজিস্ট্রেশন করা। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর কয়েকটি অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও জায়গাজমি রয়েছে। সচেতন মহল কর্তৃপক্ষকে তার সম্পদের হিসেবে নেওয়ার দাবি করে বলেন, তাহলে তার অপকৃত্তির প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হবে।
কি কথা তাহার সাথে:
অফিসে থাকাকালীন সময়ে এক্সইএন হাবিবুল এবং হাফিজুর রুমের দরজা ভেতর থেকে লক বা বন্ধ করে দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা করেন। যা দাপ্তরিক প্রয়োজনে অন্যদের কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটিয়েই চলেছে।
ফ্যাসিষ্টের ফিরে আসার স্বপ্নে বিভোর:
বিগত সময়ে নিজের ইচ্ছা ও খেয়াল খুশি মতো অফিস করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতেও তার পরিবর্তন না হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ফ্যাসিষ্টের এই সহযোগী এসডিই হাফিজুর রহমান (স্বাধীন) এর এখনও ধারণা আর অল্পদিনেই পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসবে। আর তখন সে আগের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে।
আক্রমণ ও হুমকিতে তটস্থ সহকর্মীরা:
এদিকে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টার দিকে তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবর পড়াকে কেন্দ্র করে সেন্ট্রাল স্টোর ডিভিশন অফিসের মধ্যে আক্রমণাত্মক সন্ত্রাসী স্টাইলে অন্য সহকর্মী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হাফিজুর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। জুনিঃ সহকারী ব্যবস্থাপক মো: শামসুদ্দোহা মুনসহ উপস্থিত কয়েকজনকে তার টেবিলে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। সবাইকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়াসহ গুলি করে মেরে ফেলারও হুমকি দেন। এর কিছুক্ষন পরই ডিভিশনে তার সিনিয়র উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি কি ঘটেছে তা হাফিজুরের কাছ থেকে জানতে চান। শুধুমাত্র এই কারনে তার উপরেও বেপরোয়াভাবে ক্ষীপ্ত হয়ে তাকেও হুমকি দেন হাফিজুর। এরপর নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুল হাসান চৌধুরীর উপস্থিতিতেই রুমের দরজায় হাফিজুর বেপরোয়া গতিতে লাথি মেরে প্রবেশ করেন। তখন এক্সইএন এর কক্ষের টেবিল চাপড়ানো ও উত্তেজিতভাবে বিভিন্ন রকম নোংরা গালিগালাজের শব্দ উপস্থিত সকলেই শুনতে পান।
ড. ইউনূসকে অকথ্য গালাগাল, হুমকি:
এর কিছুক্ষণ পর নির্বাহী প্রকৌশলীর রুমের বাইরে বেরিয়ে এসে হাফিজুর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উচ্চারণ করে রাজাকার, দস্যূ, চোর-বাটপার এবং দেশের সম্পদ পাচারকারী বলে চরম চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় তিনি জামায়াত-বিএনপিসহ ড. ইউনূস সরকারকে ধ্বংস করা এবং ডেসকো ও ডেসকোর ম্যানেজমেন্টকে দেখে নিবেন বলেও হুমকি দিতে থাকেন।
মদতদাতা এক্সইএন হাবিবুলের নীরবতা:
এ ঘটনার জের ধরে 'অফিসের অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রসঙ্গে' উল্লেখ করে এক্সইএন হাবিবুল হাসান চৌধুরীর নিকট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দলবদ্ধভাবে একাধিকবার হাফিজুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। কিন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দিনের পর দিন অনিয়ম-দূর্ণীতিকারী বিপিপি'র সাধারণ সম্পাদক হাফিজুরের সন্ত্রাসী স্টাইলে হুমকি দেয়ার পর থেকেই অফিসের সকলে মধ্যে আতঙ্কজনক পরিবেশ বিরাজ করছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার পরদিন গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টার দিকে অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এক্সইএন হাবিবুলের রুমে সার্বিক বিষয় নিয়ে এক আলোচনা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি হেড অফিসে শীর্ষ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে মর্মে এক্সইএন সবাইকে আশ্বাস দিয়ে তখনকার মতো পরিস্থিতি শান্ত করেন। কিন্তু বিগত প্রায় ৪ মাস ধরে অভিযুক্ত হাফিজুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা হলেও বিষয়গুলি নিয়ে আজও কোন সমাধান বা সুরাহা করেনি কেউই।
অভিযুক্ত হাফিজুরের বক্তব্য:
এদিকে, এ সকল বিষয়ে জানতে চাইলে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এগুলো মিথ্যাচার, বানোয়াট ও সাজানো বলে দাবি করেন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান (স্বাধীন)। বলেন, তার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি কখনওই কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা দেখান নাই। চীফ ইঞ্জিনিয়ার গোলাম রাব্বানী স্যার বিষয়গুলো সব জানেন আছেন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
এ ব্যাপারে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শামীম আহমেদ এইমাত্র'কে বলেন, আমি ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিষয়টি তদন্ত করে বিধি মোতাবেক কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে এ ব্যাপারে দুদকের উপপরিচালক মো: আকতারুল ইসলাম এইমাত্র'কে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ পেলে যাছাই-বাছাই করা হয়। তারপরেই আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ এইমাত্র'কে বলেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দুর্নীতিবাজ যেই হউক তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিষয়টিতে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এইমাত্র'কে বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দুর্নীতি থাকলে দেশে সুশাসন থাকবে না।
সংবাদটি ১২১ বার পড়া হয়েছে