আমার আইডল
শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ ৪:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আশির দশকের শুরু। কুষ্টিয়া শহর। ছয়ফুট লম্বা ফর্সা সুদর্শন এক মানুষ। সদা কেতাদুরস্ত। দামি প্যান্টের ওপর সাদা শার্ট, পায়ে কালোজুতো, চোখে রোদচশমা, ফর্সামুখে ঘন গোঁফ সুন্দর করে ছাঁটা। পকেটে লাল-কালো রঙের দুটি রেডলীফ কলম। হোন্ডা মোটরবাইকে দৌড়ে বেড়ান শহরের সবপ্রান্ত।
তিনি খবরওলা। খবরের মানুষ।
মজমপুর কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ সড়কের পাশে তার অফিস। একতলার দালানে ঢুকলেই চোখে পড়ে প্রিন্টিং প্রেসের কর্মযজ্ঞ। সারি সারি কাঠের গেলিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খোপে সিসার অক্ষর সাজানো। গেলির সামনে টুলে বসা কম্পোজিটর কম্পোজ করে চলেছেন। পাশেই টেডেল নামের মুদ্রণযন্ত্রের ঘটাংঘট আওয়াজে ছাপা চলছে। ঢোকার মুখে বাম দিকে কাঁচঘেরা সম্পাদকের কক্ষ। কাঁচের দরজায় লাল অক্ষরে লেখা সম্পাদক (বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ)। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘মে আই কাম ইন’ বলে দরজা সামান্য ফাঁক করলেই টেবিলে ঝুঁকে নিউজপ্রিন্টের কাগজে লেখা সংবাদ কাটাকুটির কর্মমগ্ন মানুষটির কাজে ছেদ ঘটে। চকিতে মুখ তুলে ইশারা করেন ‘ইয়েস কাম ইন’। নাম তাঁর আবদুর রশিদ চৌধুরী। আমার সাংবাদিকতা জীবনের প্রথম আইডল।
ওপরের বর্ণনা যখনকার, তখন আমি কুষ্টিয়া শহরে থাকি, প্রবেশিকাস্তরের শিক্ষার্থী। তখন থেকেই সাংবাদিকতার ভূত চেপেছিল মাথায়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক লেখার পড়ার পাঠ চুকানো তখনও সুদূর পরাহত থাকলেও ওই বয়সেই হাতেখড়ি নিতে চাচ্ছিলাম। সে কথায় পর আসছি। এর আগে শুরুরও যে শুরু আছে সে কথা বলতে চাই।
বহুমাত্রিক গুণধর খবরের মানুষ আবদুর রশীদ চৌধুরী সাহিত্যপ্রাণও বটে। বলে রাখা ভাল, আবদুর রশীদ চৌধুরী যে পরিবারের সন্তান, সেই পরিবারটিই অভিজাত, সৃষ্টিশীল, কুষ্টিয়া শহরের নামী পরিবার। তার অগ্রজ ওয়ালিউল বারী চৌধুরী তখন সাপ্তাহিক ইস্পাত এর সম্পাদক ও নামি সাংবাদিক। অনুজ আবুল আহসান চৌধুরী স্বনামখ্যাত প্রাবন্ধিক, লোক গবেষক ও সরকারি কলেজের বাংলা’র অধ্যাপক। এ সময় তিনি সাপ্তাহিক ‘জাগরণী’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। আশিদশকের গোড়ার দিকে জাগরণী’র একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা বের হয়। সারাদেশের উদীয়মান লেখকের গল্প, কবিতা, ছড়ায় সমৃদ্ধ হয়ে সে সংখ্যাটি প্রকাশ পায়। ছবি ও পরিচিতিসহ সেই সংখ্যাটি ঢাকা থেকে অফসেট প্রেসে ছাপা হয়েছিল বলে এর প্রকাশনামান ছিল উন্নত ও ঝকঝকে। কুষ্টিয়ায় তখনো অফসেট মুদ্রণ ব্যবস্থা না থাকায় অফসেটে ছাপা সবকিছুকে তখনকার বিদ্বজ্জনেরা ভিন্নচোখে দেখতেন। কিশোর বয়স থেকে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত বলে জাগরণীর এই সংখ্যা আমার লেখনসত্ত্বার অঙ্কুরোদ্গমকালে প্রভাব ফেলে। সংখ্যাটিতে আমার লেখা ছিল না বলে এলাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সংখ্যাটিতে নিজেকে উপস্থাপন করতে না পারার বেদনা ছিল। এই সংখ্যায় নিজেকে যুক্ত করতে না পারার কারণ তখনও পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ছিলাম নিতান্ত অর্বাচীন। সংখ্যাটি বহুদিন সংগ্রহে রেখে ভেবেছি কোন একদিন সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবোই করবো।
পড়ালেখা সূত্রে কুষ্টিয়া শহরে যখন থাকতে শুরু করলাম, তখন পূর্ববাসনার সূত্রে একদিন কবিতা নিয়ে হাজির হলাম জাগরণী সম্পাদকের দফতরে। তখন ‘বেকো’ নামের একটি বাইসাইকেল চালাতাম। একদিন সাইকেল চালিয়ে হাজির হলাম মজমপুরে সাপ্তাহিক জাগরণী অফিসে। দুরু দুরু বক্ষে কাঁচের দরজা ঠেলে ‘মে আই কাম ইন’ বলতেই ভিতরে যাওয়ার সম্মতি পেলাম। বিশালকায় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টো পাশে বসা সাংবাদিক আবদুর রশীদ চৌধুরী। টেবিলে ওপর ত্রিকোণাকৃতি কাঠের ওপর লেখা সম্পাদক শব্দটি। কি আশ্চর্য, শহরের অনুষ্ঠানাদি, পথ চলতে রাস্তায় মোটরবাইক দাবড়ানো যে সুদর্শনকে প্রায়শ: দেখে থাকি, ইনি তিনিই। তিনি আলাপ শুরু করলে কম্পিতবক্ষে উত্তর দিই, সামনে মেলে ধরি লিখে নিয়ে যাওয়া কবিতা। তিনি পাকা জহুরী কিনা জানিনা, ফুলস্কেপ সাদাকাগজে হাতে লিখে নিয়ে যাওয়া কবিতায় চোখ বুলিয়েই বললে ‘তোমার হবে, চালিয়ে যাও’, যোগাযোগ রেখো’।
তিনি জানেন না, তাঁর এই বাক্যটি আমার জীবন পাল্টে দিলো। বেরুতে বেরুতে ভাবলাম, আমার জীবন লেখালেখি বা সাংবাদিকতার জন্যই। গত অর্ধশতক ধরে সে পথেই হেঁটে চলেছি।
যাহোক, কবিতাটি প্রকাশিত হয় পরের সপ্তাহেই। আমার আগ্রহ-উদ্দীপনা লাফিয়ে বাড়ে। এ দিনের এই বড় হৃদয়ের বড় মানুষ আবদুর রশীদ চৌধুরী আমার ‘রশীদ ভাই’য়ে পরিণত হতে বেশিদিন নেননি। নতুনকে বরণ করার বিশাল হৃদয়, সম্ভাবনাকে খুজে বের করার মতো চোখ একজন সামান্যকে গড়ে তোলায় তার জুড়ি ছিল না। এদিকে ইতোমধ্যে আমারও একাধিক ছড়া, কবিতা, ফিচার সাপ্তাহিক জাগরণী’তে প্রকাশিত হয়ে গেছে, এছাড়া কিছুটা পক্কভাব লাভ করতে শুরু করেছি। তাই প্রথমদিনের কম্পিতহৃদয় যুবক হয়ে গেছে সম্পাদকের জুনিয়র বন্ধু। সেই সম্পর্ক দৃঢ় হতেও সময় লাগেনি। তিনি এসাইনমেন্ট পর এসাইনমেন্ট দিয়ে আমাকে সাংবাদকিতার প্রাথমিকপাঠে অনায়াসে উতরে নিতে বাড়িয়ে দেন উদারহাত।
রশিদ ভাই পরে আমাকে অফার দেন সাপ্তাহিক জাগরণী’র নিজস্ব বার্তা পরিবেশক হিসেবে কাজ করার। বেশ কয়েকবছর ধরে তা নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছি বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। কালেভদ্রে বার্তা সম্পাদকের কাজও করতে হয়েছে। তখনকার দিনে সম্মানী ছিল আজকের তুলনায় নগণ্য। তবে মাসশেষে তা হাতে পাওয়া ছিল বড় সম্মানের। এই সময়ে বা কিছু আগে রশিদ ভাই’র অগ্রজ ওয়ালীউল বারী চৌধুরীর সাপ্তাহিক ইস্পাতেও দুয়েকটি সংবাদ লেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কার্যত এই সময়টাতে কুষ্টিয়ার সাপ্তাহিক ইস্পাত, সাপ্তাহিক জাগরণী, সাপ্তাহিক গ্রামের ডাক অফিসে ছিল আমাদের উদীয়মান সাহিত্যামোদী-সাংবাদিকদের আড্ডা। এ সময় বেশ কয়েকটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেও হাত পাকাই। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।
রশীদ ভাই সম্পাদক হয়েও একজন জুনিয়র সংবাদকর্মীকে স্নেহভরা চোখে জুনিয়র বন্ধুর মতো দেখতেন । তিনি ব্যতিক্রম চরিত্রের এক সাংবাদিক-সম্পাদক। তিনি মিতবাক, নিম্নকন্ঠী এবং নিরেট ভদ্রলোক। পেশাগত কাজে তার কাছ থেকে কৃতিত্বের পুরস্কারই সব সময় পাওয়া যেতো, ভুলের ভৎর্সনা নয়। পেশাগত আলাপচারিতা তথা জরুরী কোন সিদ্ধান্তের জন্য কখনো রশীদ ভাইয়ের বাসায় যেতে হতো। অফিসের পেছন সামান্য দূরেই ছিল তার নবনির্মিত তিনতলা বাড়ি। কবি লেখক তাসলিমা চৌধুরী বুলবুল তাঁর সহধর্মিনী। প্রাইমারী স্কুলপড়ুয়া দুইকন্যা নিয়ে তখন তাদের সংসার। সে বাড়িতে গেলে রশীদ ভাই ও তাসলিমা চৌধুরী বুলবুল ভাবী কখনো না খেয়ে আসতে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না।
যে সময়ের স্মৃতিচারণ করছি, এ সময় আবদুর রশীদ চৌধুরী ঢাকার দৈনিক সংবাদ ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক জাগরণীর সম্পাদক। কাজে কাজেই একদিকে সাংবাদিকতার কর্মব্যস্ততায় তিনি সারাক্ষণ থাকতেন শশব্যস্ত, অন্যদিকে সরকারি টেলিভিশন এবং দৈনিক সংবাদ এর মতো জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক হওয়ার কারণে জেলার সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি, বেসরকারি মানুষ পর্যন্ত তিনি এ্যাকসেস পেতেন। তার কাছে বহু খবর আপনাআপনি চলে আসতো। ফলে কুষ্টিয়ার সাংবাদিকতা জগতে আবদুর রশীদ চৌধুরী এক ঈর্ষণীয় চরিত্র, একনামে চেনা এক নাম।
লেখক: মাহমুদ হাফিজ, সিনিয়র সাংবাদিক
(লেখাটি তাঁর ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
১৪০ বার পড়া হয়েছে