‘মামা বাড়ির আবদার?’: ভারতের জাকির নায়েক ফেরত চাওয়ার কূটনৈতিক দ্বৈত নীতি
রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫ ২:২৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
‘মামা বাড়ির আবদার’- এই বাঙালি প্রবাদটি দুর্বল বা অযৌক্তিক দাবিকে তাচ্ছিল্য করতে ব্যবহৃত হয়। বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক বাস্তবতায় এই শব্দবন্ধ ভারতের জাকির নায়েক প্রত্যর্পণ চাওয়ার প্রেক্ষাপটে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।
কারণ, এখানে প্রকৃত ‘আইনি অগ্রাধিকার’ ও ‘নীতিগত ন্যায্যতা’র চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ, দ্বৈত মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বলিদানটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে।
জাকির নায়েক: ৯ বছরের শূন্য বিচারের কাহিনী
২০১৬ সালের গুলশান হামলার ঘটনায় ভারতের মিডিয়া তথা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রথমবারের মতো ড. জাকির নায়েকের নাম উচ্চারণ করে। একই বছরে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA) তার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য, বেআইনি কার্যকলাপ, এবং মানি লন্ডারিং ইত্যাদি অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এরপর ২০১৭-২০১৮ ঘুরে গেছে, অথচ ভারতের কোনো আদালতে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত তিনি কোনো আদালতের ‘পলাতক’ ঘোষণাও পাননি। ভারতের আইন অনুযায়ী, গ্রেফতারি পরোয়ানার ৩০ দিনের মধ্যেই কাউকে পলাতক ঘোষণার বিধান থাকলেও, এই ব্যবস্থাটা তার ক্ষেত্রে মানা হয়নি।
যেমন: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, মুম্বাইয়ের বিশেষ আদালত, কিংবা আন্তর্জাতিক ফোরাম—কোথাও তার নামে বিচার চলে না, ইন্টারপোল কখনো তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ দেয়নি। একই সময়ে তিনি মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়ে, দেশ-বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন, উৎসব-সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন। অর্থাৎ আইনের চোখে তিনি ‘বিচারাধীন’ নয়, রাজনৈতিক এক বিতর্কিত ও আলোচিত ব্যক্তি হিসেবেই রয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনা: পলাতক, অভিযুক্ত ও আইনি তৎপরতা
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাহিনিটা একেবারেই আলাদা। ২০২৫ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের আদালত ও CID প্রকাশ্যে তার ও ২৬০ জনের নাম ‘পলাতক’ আসামী হিসেবে ঘোষণা করেছে—রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ-মামলায়। এ সংক্রান্ত নোটিশ জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। একই সময়ে ঢাকায় কর্তৃত্বশীল সরকার ভারতের কাছে একাধিকবার শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক দাবি জানিয়েছে এবং ইন্টারপোলের কাছে রেড কর্নার নোটিশ চাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারতের দায়িত্বশীল মহল স্বীকারও করেছে, ঢাকা থেকে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ চিঠি এসেছে; কিন্তু দিল্লির কোনো মন্ত্রী, কিংবা পররাষ্ট্রসচিব প্রকাশ্যে আজ পর্যন্ত হাসিনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাননি—কেবল বলেছে ‘প্রক্রিয়াধীন’ বা ‘বিবেচনাধীন’। ফলে হাসিনা নিরাপত্তাবেষ্টিত অবস্থায় দিল্লিতে রয়েছেন, কূটনৈতিক ‘গেস্ট’—কিন্তু গণহত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি ফৌজদারি অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াননি আজও।
ভারতের ‘আবদার’ আর বাংলাদেশ সরকারের ‘প্রাপ্যতা’: দ্বৈত নীতি ও উপেক্ষা
এখানেই আসে সেই বহুল আলোচিত ‘মামা বাড়ির আবদার’র প্রসঙ্গ। আইনি ন্যায্যতা ও কূটনৈতিক শিষ্টচার—দুটোই যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। ভারতের কৌশলগত সমর্থকদের মতে, তাঁদের দেশের একজন প্রচারক মুসলিম বক্তা যেকোনো দেশের মাটিতে গেলে তাকে ‘সোপর্দ’ পাওয়ার অধিকার তাদের আছে—তবে অপরপক্ষের কোনো দাবির প্রতি তারা একই উৎসাহ দেখায় না।
একদিকে, জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে এমনকি সরাসরি বিচারও হয়নি, আইনি প্রক্রিয়া প্রায় স্থবির, অথচ তার প্রবেশের খবরে দিল্লি থেকে সদলবলে ‘ফেরত চাই’ চিঠি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীন আইনি, বৃহত্তর মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত ও প্রকাশ্যে নোটিশপ্রাপ্ত এক সাবেক সরকারপ্রধান (স্বৈরাচার) ভারতের মাটিতে অবস্থান করছেন, কিন্তু তাকে ফেরত দিতে দিল্লি নীতিগত ভারসাম্য বজায় রাখার কোনো প্রয়াস দেখায় না। এখানে আইনি যুক্তি ও নীতির পরিবর্তে জোরালো প্রাধান্য পায় রাজনৈতিক সম্পর্ক, বন্ধু রাষ্ট্র হওয়া বা আন্তর্জাতিক কৌশলগত হিসাব-নিকাশ। অথচ, প্রতিদিন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিসরে এসব দ্বৈত নীতির সাক্ষ্য মিলছে।
মামলাগুলোর সময়-তারিখ ও দুই দেশের কূটনৈতিক পাঁয়তারা
২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর, ভারত সরকার বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে জাকির নায়েককে ফেরত চেয়েছে, যদিও তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের অভিযুক্তির পর যথাযথ বিচার হয়নি। একই সময়ে বাংলাদেশের নতুন সরকার ২০২৪ ডিসেম্বর ও ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার চার্জশিট, আদালতের আদেশ ও ইন্টারপোল আবেদন করে। ৩১ অক্টোবর ২০২৫, হাসিনা ও আরও ২৬০ জনের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়। এর কয়েকদিন পরপরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফেরত চেয়ে ভারতকে বার্তা—“আমাদের নির্বাচিত পলাতক আসামীকে ফেরত দিন।” কিন্তু ভারতে এরপর নিরবতা।
আন্তঃদেশীয় আইন ও চুক্তি অনুযায়ী, বস্তুনিষ্ঠ বিচারপ্রক্রিয়ার ভিত্তিতে, একজন সত্যিকারের পলাতক (proclaimed offender) অথবা আইনি প্রেক্ষাপটে রেড নোটিশ প্রাপ্ত হওয়া ব্যক্তিকে ফেরত দেওয়া নীতিগতভাবে জরুরি। এখানে বাংলাদেশের দাবির পক্ষে তথা ফেরত পাওয়া নৈতিক ও আইনি অধিকারের বিষয় থাকলেও, ভারতীয় পক্ষের ‘সোপর্দ’ আবদার আধুনিক আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রথার মানদণ্ডেও দুর্বল।
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, দেশের প্রচলিত আইন এবং কূটনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় কোনো বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ তখনই নেওয়া হয়, যদি সে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা আইনি শর্ত ভঙ্গ করে, অথবা কার্যকর আদালতের নির্দেশ ছাড়া কাউকে তৃতীয় দেশে হস্তান্তর করার সুযোগ সীমিত। ড. জাকির নায়েক এই সফরে থাকার সময় বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও ফৌজদারি মামলা বা আদালতের আদেশ না থাকায়, তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে দেশের সরকারি স্তরে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
সুতরাং, বাংলাদেশের সরকার এখন পর্যন্ত জাকির নায়েককে ভারতের কাছে সোপর্দ করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি; তার সফর চলছে এবং আগামী দিনেও সরকারের নীতিগত অবস্থান না বদলালে তাকে সোপর্দ করার সম্ভাবনা মোটেই নেই।
শেষ কথা
দক্ষিণ এশিয়ার “বড় ভাই” ও “ছোট ভাই”-এর কূটনীতিতে, আইনি দুর্বলতা ও রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে প্রকৃত ‘মামা বাড়ির আবদার’-এর প্রকাশ দেখছে দুনিয়া। যেখানে একপক্ষ ফাঁকা আইনি মামলায় বছর গোনে, প্রত্যর্পণ চায়—অন্যপক্ষ তার বিচারাধীন সরকারি কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে পাওয়ার ন্যায্যতা নিয়েও অবহেলিত হয়। এই সত্যটাই বৃহত্তর সংবাদ বিশ্লেষণ ও বিচারবোধের সামনে নতুন প্রশ্ন তোলে—এই দ্বৈত মানদণ্ড আদতে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে সুবিচার ও আইনের কোনো মানদণ্ড রাখতে পারছে কি?
সুতরাং, আজকের বাস্তবতায় ভারতের জাকির নায়েক প্রত্যর্পণের দাবিকে শুধু আইনি আবেদন বলা চলে না; বরং, একে ‘মামা বাড়ির আবদার’ বলাই যথার্থ, যেখানে আইনি নীতির গভীরে রয়েছে রাজনীতির কূটকৌশল ও স্বার্থপর জাতীয়তাবাদ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১৫০ বার পড়া হয়েছে