সর্বশেষ

সাহিত্য

দ্রোহে, সংগ্রামে, সাম্যে নজরুল

গাউসুর রহমান
গাউসুর রহমান

শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০৩ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো অপ্রত্যাশিত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী। মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রচলিত কাব্যনীতির শেকল ছিন্ন করে এক নতুন ভাবনার জন্ম দেন।

নজরুলকে প্রায়শই ‘বিদ্রোহী কবি’ বা ‘যুগস্রষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রে যে দুটি স্তম্ভ দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, তা হলো—প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি তীব্র বিদ্রোহ এবং ঐ বিদ্রোহের ফলস্বরূপ কাঙ্ক্ষিত শোষণমুক্ত সমাজ, অর্থাৎ সাম্যবাদী চেতনা।

 

রবীন্দ্রনাথের গীতিময়, আধ্যাত্মিক ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নজরুল জীবনের রুক্ষ বাস্তবতা, শোষণ এবং নিপীড়নের যন্ত্রণাকে ভাষা দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা কেবল সৌন্দর্য বা প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, তা ছিল পরাধীন জাতির স্বাধীনতা, শোষিত শ্রেণির মুক্তি এবং সামগ্রিক মানবমুক্তির শ্লোগান। 

নজরুলের বিদ্রোহ শুধুমাত্র আবেগগত কিংবা আকস্মিক ছিল না; তা ছিল সুচিন্তিত, দর্শনভিত্তিক এবং বহুমাত্রিক। এই বিদ্রোহ সমাজের সকল স্তরে বিদ্যমান বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। নজরুলের রাজনৈতিক বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন প্রত্যয়। তিনি সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসে পরাধীন ভারতের মর্মান্তিক চিত্র অনুভব করেন। তাঁর কবিতাগুলি ছিল যেনো পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

 

‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’—এসব রচনায় সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা এবং মুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য ছন্দকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ‘চল চল চল’ গানে যে অনিবার্য গতিময়তা ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল সামরিক অগ্রযাত্রার প্রতিধ্বনি নয়, তা ছিল পরাধীন জাতির মুক্তির জন্য সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান। নজরুল জানতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; তাই তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল শোষক শক্তির পতন। তাঁর এই রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে ‘জনগণের কবি’র আসনে বসিয়েছিল।

রাজনৈতিক পরাধীনতার চেয়েও গভীরে প্রোথিত ছিল সমাজের অভ্যন্তরে বিদ্যমান বৈষম্য। নজরুল সরাসরি আঘাত করেছেন বর্ণপ্রথা, জাতপাতের ভেদাভেদ এবং শ্রেণি বৈষম্যের ওপর। তিনি সমাজের উপেক্ষিত এবং পদদলিত মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন।

 

‘কুলি-মজুর’ কবিতায় তিনি স্পষ্টতই সমাজের শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতি হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। যে শ্রমিকের হাতে গড়া সভ্যতা, সেই শ্রমিকই সমাজে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত: "দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে। চোখ ফেটে এলো জল— এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?"

 

তাঁর সামাজিক বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল সমাজের তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির ভণ্ডামি, দুর্বলদের ওপর সবলের অত্যাচার এবং মানবতাকে অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কৃত্রিম বিভেদগুলির বিনাশ। নজরুলের বিদ্রোহের সবচেয়ে গভীরতম দিক হলো ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। তিনি ধর্মকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গণ্ডি থেকে মুক্ত করে তাকে সর্বজনীন মানবকল্যাণের মাপকাঠিতে বিচার করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের নামে সৃষ্ট ভেদাভেদ, অন্ধবিশ্বাস এবং ভণ্ডামিকে তিনি তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন: মানুষ যখন ধর্মকে বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তখন সেই ধর্ম কীভাবে মানবমুক্তির পথ দেখাতে পারে? তাঁর কাছে,  ধর্ম সমাজের নিপীড়িত মানুষের মধ্যেই বিরাজমান। অন্ধ আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং মানবপ্রেমই আসল ধর্ম।

 

নজরুলের বিদ্রোহের কেন্দ্রীয় কাব্যগ্রন্থ নিঃসন্দেহে ‘বিদ্রোহী’ (১৯২১)। এই কবিতাটি শুধুমাত্র একটি কাব্যিক সৃষ্টি নয়, এটি যেন নজরুলের সমগ্র জীবনদর্শন ও বিদ্রোহের ইশতেহার। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে মহাবিশ্বের সকল শক্তি, নিয়ম এবং অত্যাচারের বিপরীত শক্তি হিসেবে ঘোষণা করেন।

 

বিদ্রোহী সত্তা এখানে একাধারে বিশ্বের নিয়ন্তা এবং বিধ্বংসী শক্তি। "আমি বিশ্ববিধির বিশ্বতোড়ে বন্ধনহীন ছন্দ" – এই ঘোষণা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও সকল আরোপিত কর্তৃত্বের প্রত্যাখ্যানের প্রতীক। এই বিদ্রোহের স্বরূপ দ্বৈত—বিধ্বংসী এবং সৃষ্টিকারী।

"আমি ভাঙব, আমি গড়ব, আমি চলে যাব সব ছাপিয়ে—"এই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির উল্লাস, পুরাতন জীর্ণতাকে সরিয়ে ভবিষ্যতের মুক্ত সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল হিন্দু পুরাণ, মুসলিম ইতিহাস এবং বিশ্ব সাহিত্যের নানা উপমা ব্যবহার করে নিজেকে সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এক সর্বজনীন মানবশক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নজরুলের বিদ্রোহের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সাম্য প্রতিষ্ঠা। তাঁর সাম্যবাদী দর্শন কোনো সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ দ্বারা চালিত ছিল না, বরং তা ছিল গভীর মানবতাবোধের ফসল। তাঁর কাছে মানুষই পরম সত্য। নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার মূলমন্ত্র ছিল মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা। তিনি

 

স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন: "মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।" এই দর্শন তাঁকে সকল মানুষের প্রতি সমব্যথী করে তুলেছিল। তাঁর সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন এক বিস্ময়কর মাত্রা লাভ করে। তিনি দ্বিধাহীনভাবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সাহিত্যকে একই বন্ধনে নিয়ে আসেন। তিনি একদিকে যেমন শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন এবং শাক্তপদ রচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি হামদ, নাত ও গজল রচনা করে উভয় সম্প্রদায়ের ভক্তি ও ভালোবাসার পাত্র হয়েছেন।

 

নজরুল হিন্দু-মুসলমানকে একই জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেছেন: "মোরা একই বৃন্তে দু'টি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" তিনি ধর্মকে ঐক্যের বন্ধন হিসেবে দেখেছিলেন, বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে নয়। তাঁর সাম্যবাদ ছিল সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে। 

বিশ শতকের গোড়ার দিকে সংঘটিত রুশ বিপ্লব (১৯১৭) এবং পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের উত্থান নজরুলের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ছিলেন শোষিত শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির কণ্ঠস্বর। তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতি জোরালো সমর্থন দেখা যায়। তিনি সমাজের সর্বহারা শ্রেণির প্রতি সংহতি জানিয়ে সমাজের সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে কেন কুক্ষিগত থাকবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন।
নজরুলের শ্রেণিচেতনা ছিল মার্কসবাদী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত, কিন্তু তা বাঙালির নিজস্ব আবেগ ও ভাষায় প্রকাশিত। তিনি তথাকথিত 'বাবু' সমাজের সমালোচনা করে শ্রমজীবী মানুষকে ‘পূজারী’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন, যারা জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলে।

 

নজরুলের বিদ্রোহ ও সাম্যবাদী দর্শন কেবল বিষয়বস্তুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা তাঁর কাব্যশৈলীতেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। তিনি বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদী, শান্ত ধারার বাইরে এক নতুন গতির সঞ্চার করেন।

 

নজরুলের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার ওজস্বিতা (Vigour)। বিপ্লবী ভাবনা প্রকাশের জন্য তিনি এমন শব্দ এবং ছন্দের বিন্যাস তৈরি করেন যা পাঠককে আলোড়িত করে। তিনি প্রচলিত মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কাঠামো ভেঙে দিয়ে মুক্তক ছন্দের ব্যবহারকে প্রবর্তন করেন, যা তাঁর কবিতাকে গতিময়তা ও বিদ্রোহের উপযোগী একটি ছন্দোবদ্ধ প্রবাহ দিয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দোবদ্ধতা কেবল ভাবনার নয়, গতিরও বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নজরুল তাঁর কবিতায় দেশি-বিদেশি শব্দাবলীর, বিশেষত আরবি, ফারসি এবং লোকায়ত বাংলা শব্দের এক অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেখানে সংস্কৃত-প্রধান ভাষার আধিপত্য ছিল, সেখানে নজরুল সমাজের সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত শব্দকে সাহসের সঙ্গে কাব্যে স্থান দেন। এই ভাষাশৈলী তাঁর কবিতাকে এক ধরনের লৌকিক ও গতিময়তা দান করে এবং বাংলা ভাষাকে এক অভিজাত গণ্ডি থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এটি ছিল এক অর্থে ভাষার গণতন্ত্রীকরণ।

 

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মূলত এক মানবতাবাদী কবি, যাঁর সাহিত্য বিদ্রোহ ও সাম্যের দুই স্রোতে বিভক্ত হয়ে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। তাঁর বিদ্রোহ ছিল কেবল ধ্বংসের জন্য নয়, বরং সৃষ্টির জন্য; নতুন, শোষণমুক্ত এক সমাজ নির্মাণের জন্য। রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয়—সকল প্রকার শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে তাঁর আপোষহীন অবস্থান তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। 

নজরুল দেখিয়েছেন, মুক্তি কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই আসে না, মুক্তি আসে মানুষের আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা, শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে সমাজের নিরাময়ের মাধ্যমে। তাঁর সাম্যবাদী চেতনা কেবল তত্ত্বকথা ছিল না, তা ছিল তাঁর জীবনবোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

তাঁর কাব্যশৈলীর নবায়ন এবং ভাষাকে গণমুখী করার প্রচেষ্টা বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিল। তাঁর কবিতা কেবল অতীত বা বর্তমানের প্রতিধ্বনি নয়, বরং ভবিষ্যতের সেই মুক্তিকামী সমাজের স্বপ্ন, যেখানে মানুষ হবে সবচেয়ে মহীয়ান—এই দর্শনই নজরুলকে আজও প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।

 

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা। 

১৫২ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন