মুজিববাদ কি একটি মিথ নাকি কথাপ্রবণতা শুধু

শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫ ১১:১৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আজ লিখতে মনস্থ করেছি এই দেশের বর্তমান রাজনীতিতে বহুল আলোচিত "মুজিববাদ" নিয়ে। আশা করি আপনাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবেন এই লেখাটি থেকে। আপনাদের আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই লেখায়।
"মুজিববাদ" কোথায় উৎপত্তি বা কোথায় বা এর শেষ আবার কি, এবং কেন এই তত্ত্বের কথাটির উৎপত্তি তা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে সেই স্বাধীনতার উষালগ্নে, ১৯৭২-৭৩ সালে। তখন কেবল কলেজে ঢুকেছি। মনের মাঝে নতুন জীবনের জয়গান। ম্যাট্রিকের পরে কলেজে ভর্তি হয়েছি। নতুন জীবনেও এসেছে পরিবর্তনের হাওয়া। খোলা বর্ডার পেরিয়ে এ দেশে ঢুকেছে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ। সেই সূত্রে আমরা গ্রন্থিত হয়েছি। বাম ধারায় দীক্ষা নিতে দেরী হয়নি। আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারায় দীক্ষিত একদল তরুণ তুর্কি। কলেজ যাই আর আসি। বিরতিতে ছাত্ররাজনীতিতে সময় দিই।
এর মাঝে একদিন দেওয়াল জুড়ে নতুন পোস্টার চোখে পড়লো-- "বিশ্বে এলো নতুন বাদ - মুজিববাদ, মুজিববাদ"।
এ আবার কোন ধারার রে বাবা! জানলাম শহরে সামনেই হবে নতুন সংগঠন "আওয়ামী যুব লীগ" এর সম্মেলন। সেখানে আসছেন আওয়ামী যুব লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি। তাহলেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি তখনই ৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী যুব লীগ? না, যারা জানেন তারা জানেন, যারা জানেন না তারা জেনে নিন— "আওয়ামী যুব লীগ" এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। প্রথম সভাপতি ছিলেন মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি।
কিন্তু এই মুজিববাদের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ৭১ সালের শেষার্ধে। জাসদের জন্মের আগে "শেখ মুজিবের পথ ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন করো" শ্লোগান বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল, তখনই কেউ একজন ভেবেছিলেন "মুজিববাদ" জন্মের ভাবনা। তিনি আর কেউ নন, বরং বলা যায়, তিনি ছিলেন দাদাভাই সিরাজুল আলম খান।
আমি যতদূর জানি, "দাদাভাই" বিশ্বাস করতেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর পাকিস্তানের জেল থেকে দেশে আসবেন না। তাই তিনি মুজিবের আদর্শ ও মুজিবের বাংলাদেশকে চিরজীবী করতে এই "মুজিববাদ" নামক চিন্তা ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, যার মূল স্তম্ভ ছিল— ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাংলাভাষী জাতীয়তাবাদ। এই চার স্তম্ভ এখনো আমাদের মহান সংবিধানে বিদ্যমান।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, শেখ সাহেব পাকিস্তানের বন্দী দশা থেকে ফিরে এলেন দেশে। সিরাজুল আলম খানের জন্য এটি প্রাথমিক ধাক্কা হতে পারে। তবে ভাববেন না আমি বলছি, শেখ সাহেব ফিরে আসায় দাদাভাই হতাশ হয়েছিলেন, বরং এটা সত্য যে, দাদা ভাই শেখ সাহেবকে নিয়েই তার ধারণা বা তত্ত্বের বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখলেন। কারণ নেতা তো আমাদের মাঝেই রয়েছেন।
কিন্তু সময় বাধা সৃষ্টি করলো অন্যখানে। ছাত্র লীগ দুই ভাগ হয়ে গেল। সম্মেলনে শেখ সাহেব আসবেন বলে প্রচার হলেও শেষ পর্যন্ত নেতা এলেন না। ছাত্র লীগের এক অংশ হয়ে গেল জাসদ, অন্য অংশ হলো ছাত্রলীগ, এবং এখান থেকেই তৈরি হলো "আওয়ামী যুব লীগ"।
এর পরে হাইজ্যাক হয়ে গেল "মুজিববাদের" ধারণা। সিরাজুল আলম খান এর পরে, মুজিববাদের নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও, শেখ মনির যুবলীগ সেই মুজিববাদ টেনে নিয়ে গেলো। কিন্তু এর পরে এলো ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালরাত্রি। জাতি হারালো তার সূর্য সন্তানদের।
শেখ সাহেবের এই করুন বিদায়ের মাঝেই হারিয়ে গেল নতুন বাংলাদেশের নতুন তত্ত্বের কথা—"মুজিববাদ"। এর পরে আর "মুজিববাদ" নিয়ে উচ্চবাচ্য ও শুনি নাই, বা শ্লোগান শুনি নাই।
তাহলে দেখা যায়, "মুজিববাদ" একটি হারিয়ে যাওয়া মিথ। যার কোনো প্রকাশ এখন এই জগতে নেই।
তাহলে এত উচ্চবাচ্য কেন? কেনই বা মুজিবের আদর্শ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা?
এই যে "মুজিববাদ" ধ্বংস করার জন্য এখন যে হুংকার, গোপালগঞ্জে এত হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার ও ধ্বংস, তার কারণ কি? কিংবা শেখ সাহেবের ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, তাই বা কেন?
আমি ভাবি অন্য কিছু। হয়তো এই ছেলেরা পড়াশোনা করেনি, বাংলার ইতিহাস জানে না, বা তাদের মনে অন্য কিছু আছে—কি সেটা? সেটি হলো, শুধু "মুজিববাদ" নয়, আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও পুরোপুরি পাল্টে দেবার মানসিকতা তাদের সারাজীবন জুড়ে। এমনকি তারা ভুলিয়ে দিতে চায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সকল ইতিহাস। এটা খুবই বিপদজনক।
কিন্তু লক্ষ্য করুন, নতুন এই ছাত্রদের জোটটি কখনই মুখ ফুটে বলছে না "বাকশাল" এর কথা! "মুজিববাদ" যতটা অপ্রাসঙ্গিক, ততটাই অপ্রাসঙ্গিক নয় "বাকশাল"। নেতার অসমাপ্ত কর্ম শেষ করার তাগাদা কাদের মনে থাকতে পারে।
রাজনীতির সহজ পাঠ যারা জানে না বা জানার ইচ্ছে করে না, তারা জেনে শুনে হলেও এমন কথা বলছে না যাতে তা ফিরে আসতে পারে—অর্থাৎ "বাকশাল" আবার ফিরে আসুক। সেটি তাদের অন্তরে বিরাজমান। এ জন্য তারা বলে "মুজিববাদের" কথা।
কিন্তু যেমনভাবে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টায় লিপ্ত, তাতে আসলে কোন ব্যবস্থা ফিরে আসবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। আমাদের দেখতে হবে, এই অপরিণামদর্শী রাজনীতির শেষ কোথায়?
পরিশেষে, "মুজিববাদ" মূলসহ উপড়ে ফেলতে গিয়ে যে অমূল্য প্রাণ হারিয়েছে, সেই স্মৃতিতে আমি দুঃখ, শোক ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
১৬৯ বার পড়া হয়েছে