১৯ জুলাই ২০২৪
১৪৮ মধ্যে ১০ নারী নিহত, স্মরণীয় শহীদ “নাইমা সুলতানা”

শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫ ৭:৫৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৯ জুলাই ২০২৪ ইতিহাসের পাতায় একটি ভয়ঙ্কর ও নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্ররা এই দিনে সর্বাত্মক অবরোধ, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন, রাষ্ট্রজুড়ে কারফিউ আরোপ, ইন্টারনেট সম্পূর্ণ বন্ধ ও অত্যন্ত ক্ষমতাশালী দমন-পীড়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
ছাত্রদের দীর্ঘদিনের অবরোধ ও আন্দোলনে ১৯ জুলাই সরকার কঠোর কৌশল নেয়। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের টহল বাড়াতে দেখা যায়, দুপুরে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে থাকে। আন্দোলনকারী ও ছাত্র-জনতার সাথে সরকারের সমর্থক ছাত্রলীগ ও পুলিশের মিশ্রিত বাহিনীর সংঘর্ষ চরমে ওঠে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরসমূহে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, এবং সরাসরি গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও হল আক্রান্ত হয় এবং নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ও সাধারণ কর্মজীবীরা আটকা পড়েন।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশালসহ দেশের ৪৭টি জেলায় পথে নামে অগণিত ছাত্র-জনতা। ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও শিক্ষক, সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের ঢেউকে আরো প্রবল করে তোলে।
আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ সরকারি স্থাপনা, টেলিভিশন সেন্টার, ও প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ সংগঠিত করে। কোথাও কোথাও সরকারি বাহিনীর হামলায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
জনশুমারিতে ১৪৮ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ১০ জন নারী এবং অশংখ্য শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ ছিলেন। আহতের সংখ্যা ১,৫০০-২,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
ঢাকার মেট্রো রেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে বড় ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের চলমান উত্তাল পরিস্থিতিতে বিকালে এই দুইটি স্টেশনে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। এতে টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, যাত্রী প্রবেশের স্বয়ংক্রিয় দরজা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ নানা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সরকার দিনের শেষভাগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাত আনুমানিক ১২টার দিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। কারফিউ জারির সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে তথ্যপ্রবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের কর্মীদেরও উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল সংঘর্ষ ও গণগ্রেফতারে। একদিনেই শতাধিক ছাত্রনেতা ও সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হন এবং বেশকিছু নেতা নিখোঁজ হন।
আন্দোলনের এই দিনে অনেক সাধারণ নারী-পুরুষ শহীদ হন, নাইমা সুলতানা (১৫), রিয়া গোপা (৬), রিতা আক্তার (১৭), নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭), মায়া ইসলাম (৬০), শাহিনুর বেগম (৫৫), নাসিমা আক্তার (২৪), মেহেরুন নেসা (২২), লিজা আক্তার (২১), সুমাইয়া আক্তার (২০)। তাঁদের কেউ আন্দোলনের মিছিলে, কেউ বাসার বারান্দায়, কেউবা কর্মস্থলে গুলিবিদ্ধ হন। মাত্র ১৫ বছর বয়সী নাইমা সুলতানা ছিলেন ঢাকা উত্তরার মিলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। আন্দোলনের ভেতরও বাড়িতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। বিকেলে বেলকুনি থেকে কাপড় তুলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বাবা ডাক্তার গোলাম মোস্তফা এবং মা আয়নুন নাহার—পরিবারের প্রত্যেকেই তাঁর অকালমৃত্যুর শোকবিহ্বল সাক্ষী। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী শহীদের আত্মত্যাগের কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সরকার ১৮ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৯ জুলাই রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়, ফলে দেশ কার্যত ইন্টারনেটবিহীন হয়ে পড়ে।
রাজধানীসহ সারাদেশে পুলিশের বহুমুখী কড়া অ্যাকশন; পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের কর্মীরা নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে লাঠিচার্জ ও হামলায় অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থিত বাহিনীর সাথে শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হামলার মুখে পড়ে। পুলিশের কিছু জায়গায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার খবর পাওয়া যায়। ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল কেন্দ্রিক বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনে সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়, যেকারণে গ্রেফতার হয় শতাধিক ছাত্রনেতা।
দিনটির সরকারদলীয় প্রতিক্রিয়ায় শহীদদের আত্মদানের জন্য বরং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সরকার-বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে দায়ী করে ধারাবাহিক বিবৃতি দেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী তখন ঢাকায় থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছিলেন; তার নির্ধারিত স্পেন সফর আন্দোলনের কারণে শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়।
সরকার বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে জনমনে চরম অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করে এবং একই সময়েই সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাত ১২টার পরপরই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং কারফিউ কার্যকর হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ মাইলফলক ছিল।
১৯ জুলাই ২০২৪ একদিকে যেমন ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের দিন, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, সেনা মোতায়েন ও গণহত্যার কালো ইতিহাস। এই দিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনায় চিরকাল গভীর ক্ষত ও নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসাবে থেকে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
১১২ বার পড়া হয়েছে